কদরুদ্দীন শিশির:
দেশের অন্যতম শীর্ষ ‘ভিজিটেড’ অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে গতকাল ৬ আগস্ট। বিএনপির নতুন ঘোষিত কমিটির ওপর একটি ‘সাইডস্টোরি’। শিরোনাম হল: “পিএস থেকে পাশের চেয়ারে!”
বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) এবং বর্তমানে দলটির নেতা (বাংলাদেশ থেকে অপহৃত হয়ে ভারতে আটক আছেন) সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে প্রতিবেদনটি। তিনি খালেদা জিয়ার পিএস থেকে ‘এত বড়’ নেতা হয়ে গেলেন তা একটু শ্লেষাত্মকভাবে শিরোনামে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু প্রতিবেদনটির ভেতরে ‘তথ্য’ আকারে যা দেয়া হয়েছে এবং যে ধরনের ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে তা সাংবাদিকতার যে কোনো মানদণ্ডে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং নোংরা বলে বিবেচিত হবে। এক কথায়, এটি কোনো হিসেবে একটি ‘সংবাদ প্রতিবেদন’ হয়ে উঠেনি। একটি দল এবং সেটির একজন নেতার প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় বিষোদ্গার ও মিথ্যাচার হয়েছে মাত্র।
সাত প্যারার প্রতিবেদনটির প্রতিটি প্যারা তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করবো এটিতে থাকা মিথ্যাচার ও বিদ্বেষের মাত্রা কী পরিমাণে বিদ্যমান।
“সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট” এর ক্রেডিটলাইনে রিপোর্টটির প্রথম প্যারা হচ্ছে--
“দারুণ চমক দেখালেন সালাহউদ্দিন আহমেদ! সরকারের আমলা হিসেবে যে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পারসোনাল সেক্রেটারি (পিএস), তিনিই এখন দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে বসবেন খালেদা জিয়ার পাশের চেয়ারে। দল পরিচালনার জন্য দেবেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। ব্যক্ত করবেন মতামত।”
এখানে এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন, একজন পিএস এর একটি দলের নীতিনির্ধারক হওয়াটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই অদ্ভুত বা নতুন কিছু! অথচ বাস্তবে এটি খুবই স্বাভাবিক চর্চা এখানে। একটি উদাহরণই যথেষ্ট এক্ষেত্রে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বর্তমানে দলটির অন্যতম নেতা। তিনি ৫ জানুয়ারির আগের সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং একই সাথে দলের মুখপাত্রও ছিলেন। এই হাছান মাহমুদ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার পিএস ছিলেন। বরং প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থা খালেদা জিয়ার পিএস থাকা সালাহউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী না থাকাবস্থায় শেখ হাসিনার পিএস থাকা হাছান মাহমুদের চেয়ে প্রোটোকলে কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকার কথা! সেই হাছান মাহমুদের পরে এক সময় সরকারের নীতিনির্ধারনী সভা- মানে মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়াতে কেউ বিষ্মিত না হলে বা নেতিবাচকভাবে না নিলে, সালাহউদ্দিন আহমেদ তার দলের নীতিনির্ধারনী সভার সদস্য নিযুক্ত হলে বিষ্মিত হবার কী আছে? বা এটিকে ‘খোঁচা মেরে’ প্রতিবেদন প্রকাশ করার কী আছে!
দ্বিতীয় প্যারা--
“সালাহউদ্দিন আহমেদের অতীত রেকর্ড ঘেটে দেখা যায়, সরকারের আমলা হিসেবে যেমন দুর্নীতিতে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন, ঠিক তেমনি আমলা থেকে আবার রাজনীতিবিদ বনে যাওয়ার পর প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়ও দুর্নীতিতে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন।”
পেশাগত কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে অল্পবিস্তর খোঁজ রাখা তথ্য থেকে যা জানি তাতে বলা যায়, সালাহউদ্দিন আহমেদের ব্যাপারে এখানে জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে। বিএনপির গত সরকারের আমলে সিনিয়র মন্ত্রীদের অনেকের ভয়াবহ দূর্নীতির মধ্যেও যে ক’জন মন্ত্রী ও নেতা কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন ইমেজ রক্ষা করে চলতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদও ছিলেন একজন।
কম নির্ভরযোগ্য হলেও একটা ছোট্ট সূত্র অবলম্বন করা যেতে পারে বিষয়টা যাচােইয়ের জন্য। গুগলে বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষায় সার্চ করে সালাহউদ্দিনের দূর্নীতি সংক্রান্ত একটি ছোটখাটো রিপোর্টও পাওয়া যায়না। অন্যদিকে উপরে উল্লিখিত আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী এবং শেখ হাসিনার সাবেক পিএস হাছান মাহমুদ এবং তার ‘সুখী বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ এর দূর্নীতি নিয়ে অসংখ্য রিপোর্ট পাওয়া যায়।
তৃতীয় প্যারা--
“তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব চেয়ে নিন্দিত কাজটি তিনি করেছেন জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাস নির্ভর আন্দোলনের সময়। চারদিকে যখন পেট্রোল বোমায় নিরীহ নারী শিশু মরছিল, ঠিক সেই সময় অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা ও প্রেসরিলিজ পাঠিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার মিছিলে নতুন মাত্রা যোগ করছিলেন তিনি।”
প্রথম প্যারায় রিপোর্টার তার নিজের মন্তব্য দিয়ে শুরু করার পর দ্বিতীয় প্যারায় কথিত ‘রেকর্ড ঘেঁটে দেখার’ কথা বলে মিথ্যাচার করা হয়েছে। তৃতীয় প্যারায় এসে তথ্যকে টুইস্ট করে অতিরঞ্জিত প্রোপাগান্ডা করছে বাংলানিউজ ‘সংশ্লিষ্টরা বলছেন’ এর মাধ্যমে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত একপেশে নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে বেশ কিছু মানুষ সহিংসতা মারা গেছেন এটা ঠিক। কিন্তু তাতে সরকারের দায়কে একপাশে ঠেলে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক বিরোধীদের গুম খুন করার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে মাঠে নেমে অহিংস আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দেয়ার পর সহিংসতায় রূপ নেয়া আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাস-নির্ভর’ বলে অভিহিত করা এবং তার দায় এককভাবে আন্দোলনকারীদের উপর ফেলা, এবং বিশেষ করে তখন বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করা সালাহউদ্দিনের ওপর দোষ চাপানো সরকারি আর যাইহোক সাংবাদিকতা নয়। বরং তথ্যবিকৃতি এবং ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অতিরঞ্জিত প্রোপাগান্ডা।
চতুর্থ প্যারা--
“সূত্রমতে, এক সময় সরকারকে বিপদে ফেলতে নিজেই অজ্ঞাত স্থান থেকে গুম হয়ে যান। অবশেষে গোপনে বর্ডার পার হয়ে ভারতের সবচেয়ে নান্দনিক, নিরাপদ ও উপভোগ্য স্থান মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে গিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন।”
সবচেয়ে ভয়াবহ ও নোংরা মিথ্যাচারটি করা হয়েছে এখানে। ২০১৫ সালের ২৩ মে ভারতের ‘দ্য ওয়্যার’ সংবাদমাধ্যমে “Anatomy of a Disappearance, and a Reappearance” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান এবং মুক্তাদির আল রশীদের অনুসন্ধানে উঠে আসে কিভাবে বাংলাদেশের সরকারি আইনশৃংখলাবাহিনী সালাহউদ্দিনকে তার গুলশানের একটি বাড়ি থেকে গোপনে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এবং তার কিছুদিন পরেই তাকে ভারতের শিলংয়ে একটি রেল স্টেশনের পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। এ নিয়ে ‘দ্য ওয়্যারের’ আগে বাংলাদেশের নিউজ এইজ পত্রিকায়ও অনুসন্ধানি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। Understanding Salah Uddin’s disappearance
সেই অপহরণকেই বাংলানউজ বলছে “সরকারকে বিপদে ফেলতে নিজেই অজ্ঞাত স্থান থেকে গুম হয়ে যান”!
পঞ্চম প্যারা--
“বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করার পাশাপাশি ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের কাজটিও করে ফেলেন সালাহউদ্দিন। যার ফলে কাগজপত্র ছাড়া অনুপ্রবেশের অপরাধে গ্রেপ্তার হলেও ভারত সরকারের অনুকম্পায় জামিনে মুক্ত হয়ে সরকারি কটেজে অবস্থান করছেন।”
এই প্যারায় ‘ভারত সরকারের’ শব্দদ্বয়ের পরে ‘অনুকম্পায়’ শব্দটির ব্যবহার দৃষ্টি আকর্ষণীয়। পার্শ্ববর্তী একটি দেশের সাবেক এক মন্ত্রী গুম হয়ে অপহৃত অবস্থায় ভারতের সীমান্তে ঢুকে যাওয়ার পর তার সাথে আইনগত আচরণ করাটা বাংলানিউজের কাছে ‘অনুকম্পা’ প্রদর্শন ঠেকেছে! তাকে ওখানে আবার ভারত সরকার গুম করে ফেললে হয়তো বাংলানিউজ সেটিকে ‘স্বাভাবিক আচরণ’ বলতো! একই সাথে বাংলানিউজ গুম হয়ে অপহৃত সালাউদ্দিনের কাছে কেন ‘কাগজপত্র’ নাই সেই প্রশ্ন তুলছে এবং অপহরণকারীদের দ্বারা সীমান্ত পার হতে বাধ্য হওয়াকে ‘অনুপ্রবেশের অপরাধ’ বলছে!
ষষ্ঠ প্যারা--
“কারো কারো মতে, খালেদা জিয়া আসলে সালাহউদ্দিনকে দিয়ে বড় ধরনের গেম খেলতে চেয়েছিলেন। তাকে দিয়ে গুমের নাটক সাজিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলাই তার লক্ষ্য ছিল।”
একাধিক দেশি বিদেশী সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে প্রমাণিত একটি গুমের ঘটনাকে কিভাবে উল্টিয়ে সেটিকে বিরোধী দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে ‘গেম খেলা’র অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করানো যায় তার একটি নির্মম উদাহরণ এই প্যারাটি। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের বিরুদ্ধে এমন ‘কারো কারো মতে’র বরাতে মিথ্যাচার করা আইনত বড় ধরনের মানহানির অপরাধ। কিন্তু বাংলানিউজ সরকারি দলের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে নির্ভয়ে এমন মানহানিকর বক্তব্য প্রচার করে যাচ্ছে।
সপ্তম প্যারা--
“সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনা যাই ঘটুক। মাঝখান থেকে লাভবান হয়েছেন সালাহউদ্দিন নিজেই। এক সময় সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির এমপি-মন্ত্রী এমনকি মাঝারি মানের নেতাদেরকেও জ্বি ম্যাডাম, জ্বি স্যার বলতে বলতে যিনি মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলতেন, সেই তিনিই এখন খালেদা জিয়ার পাশের চেয়ারে বসবেন। আর দলের অনেক যোগ্য, পরিক্ষীত, প্রবীণ, প্রাজ্ঞ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদের পেছনে বসে তার ক্যারিশমাটিক উত্থান চেয়ে চেয়ে দেখবেন।”
“জ্বি ম্যাডাম, জ্বি স্যার বলতে বলতে যিনি মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলতেন” এই ধরনের ভাষা সংবাদমাধ্যমের ভাষা তো নয়ই, প্রচলিত মুখের ভাষা হিসেবেও অত্যন্ত ইতর শ্রেণীর।
বাংলাদেশ সরকার যখন ‘অসাংবাদিকতাসুলভ’ আচরণের অভিযোগে এক সাথে ৩৫টি অনলাইন সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন সরকারের স্বার্থ রক্ষা করে এবং সরকারের বিরোধীদের ঘায়েল করার ইচ্ছা থেকে বাংলানিউজের মতো চরম মিথ্যাচার এবং নোংরামি করে রিপোর্ট প্রকাশ করলে তা ‘অসাংবাদিকতাসুলভ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে না! এটাই বর্তমান বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জগতের একটি বাস্তবতা।
দেশের অন্যতম শীর্ষ ‘ভিজিটেড’ অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে গতকাল ৬ আগস্ট। বিএনপির নতুন ঘোষিত কমিটির ওপর একটি ‘সাইডস্টোরি’। শিরোনাম হল: “পিএস থেকে পাশের চেয়ারে!”
বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) এবং বর্তমানে দলটির নেতা (বাংলাদেশ থেকে অপহৃত হয়ে ভারতে আটক আছেন) সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে প্রতিবেদনটি। তিনি খালেদা জিয়ার পিএস থেকে ‘এত বড়’ নেতা হয়ে গেলেন তা একটু শ্লেষাত্মকভাবে শিরোনামে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু প্রতিবেদনটির ভেতরে ‘তথ্য’ আকারে যা দেয়া হয়েছে এবং যে ধরনের ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে তা সাংবাদিকতার যে কোনো মানদণ্ডে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং নোংরা বলে বিবেচিত হবে। এক কথায়, এটি কোনো হিসেবে একটি ‘সংবাদ প্রতিবেদন’ হয়ে উঠেনি। একটি দল এবং সেটির একজন নেতার প্রতি চরম বিদ্বেষপূর্ণ ভাষায় বিষোদ্গার ও মিথ্যাচার হয়েছে মাত্র।
সাত প্যারার প্রতিবেদনটির প্রতিটি প্যারা তুলে ধরে দেখার চেষ্টা করবো এটিতে থাকা মিথ্যাচার ও বিদ্বেষের মাত্রা কী পরিমাণে বিদ্যমান।
“সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট” এর ক্রেডিটলাইনে রিপোর্টটির প্রথম প্যারা হচ্ছে--
“দারুণ চমক দেখালেন সালাহউদ্দিন আহমেদ! সরকারের আমলা হিসেবে যে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পারসোনাল সেক্রেটারি (পিএস), তিনিই এখন দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক হিসেবে বসবেন খালেদা জিয়ার পাশের চেয়ারে। দল পরিচালনার জন্য দেবেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। ব্যক্ত করবেন মতামত।”
এখানে এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন, একজন পিএস এর একটি দলের নীতিনির্ধারক হওয়াটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই অদ্ভুত বা নতুন কিছু! অথচ বাস্তবে এটি খুবই স্বাভাবিক চর্চা এখানে। একটি উদাহরণই যথেষ্ট এক্ষেত্রে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক হাছান মাহমুদ বর্তমানে দলটির অন্যতম নেতা। তিনি ৫ জানুয়ারির আগের সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন এবং একই সাথে দলের মুখপাত্রও ছিলেন। এই হাছান মাহমুদ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে শেখ হাসিনার পিএস ছিলেন। বরং প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থা খালেদা জিয়ার পিএস থাকা সালাহউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী না থাকাবস্থায় শেখ হাসিনার পিএস থাকা হাছান মাহমুদের চেয়ে প্রোটোকলে কিছুটা হলেও পিছিয়ে থাকার কথা! সেই হাছান মাহমুদের পরে এক সময় সরকারের নীতিনির্ধারনী সভা- মানে মন্ত্রিসভার সদস্য হওয়াতে কেউ বিষ্মিত না হলে বা নেতিবাচকভাবে না নিলে, সালাহউদ্দিন আহমেদ তার দলের নীতিনির্ধারনী সভার সদস্য নিযুক্ত হলে বিষ্মিত হবার কী আছে? বা এটিকে ‘খোঁচা মেরে’ প্রতিবেদন প্রকাশ করার কী আছে!
দ্বিতীয় প্যারা--
“সালাহউদ্দিন আহমেদের অতীত রেকর্ড ঘেটে দেখা যায়, সরকারের আমলা হিসেবে যেমন দুর্নীতিতে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন, ঠিক তেমনি আমলা থেকে আবার রাজনীতিবিদ বনে যাওয়ার পর প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময়ও দুর্নীতিতে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন।”
পেশাগত কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে অল্পবিস্তর খোঁজ রাখা তথ্য থেকে যা জানি তাতে বলা যায়, সালাহউদ্দিন আহমেদের ব্যাপারে এখানে জঘন্য মিথ্যাচার করা হয়েছে। বিএনপির গত সরকারের আমলে সিনিয়র মন্ত্রীদের অনেকের ভয়াবহ দূর্নীতির মধ্যেও যে ক’জন মন্ত্রী ও নেতা কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন ইমেজ রক্ষা করে চলতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমেদও ছিলেন একজন।
কম নির্ভরযোগ্য হলেও একটা ছোট্ট সূত্র অবলম্বন করা যেতে পারে বিষয়টা যাচােইয়ের জন্য। গুগলে বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষায় সার্চ করে সালাহউদ্দিনের দূর্নীতি সংক্রান্ত একটি ছোটখাটো রিপোর্টও পাওয়া যায়না। অন্যদিকে উপরে উল্লিখিত আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী এবং শেখ হাসিনার সাবেক পিএস হাছান মাহমুদ এবং তার ‘সুখী বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’ এর দূর্নীতি নিয়ে অসংখ্য রিপোর্ট পাওয়া যায়।
তৃতীয় প্যারা--
“তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব চেয়ে নিন্দিত কাজটি তিনি করেছেন জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাস নির্ভর আন্দোলনের সময়। চারদিকে যখন পেট্রোল বোমায় নিরীহ নারী শিশু মরছিল, ঠিক সেই সময় অজ্ঞাত স্থান থেকে ভিডিও বার্তা ও প্রেসরিলিজ পাঠিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যার মিছিলে নতুন মাত্রা যোগ করছিলেন তিনি।”
প্রথম প্যারায় রিপোর্টার তার নিজের মন্তব্য দিয়ে শুরু করার পর দ্বিতীয় প্যারায় কথিত ‘রেকর্ড ঘেঁটে দেখার’ কথা বলে মিথ্যাচার করা হয়েছে। তৃতীয় প্যারায় এসে তথ্যকে টুইস্ট করে অতিরঞ্জিত প্রোপাগান্ডা করছে বাংলানিউজ ‘সংশ্লিষ্টরা বলছেন’ এর মাধ্যমে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত একপেশে নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনে বেশ কিছু মানুষ সহিংসতা মারা গেছেন এটা ঠিক। কিন্তু তাতে সরকারের দায়কে একপাশে ঠেলে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক বিরোধীদের গুম খুন করার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে মাঠে নেমে অহিংস আন্দোলনের পথ রুদ্ধ করে দেয়ার পর সহিংসতায় রূপ নেয়া আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাস-নির্ভর’ বলে অভিহিত করা এবং তার দায় এককভাবে আন্দোলনকারীদের উপর ফেলা, এবং বিশেষ করে তখন বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করা সালাহউদ্দিনের ওপর দোষ চাপানো সরকারি আর যাইহোক সাংবাদিকতা নয়। বরং তথ্যবিকৃতি এবং ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অতিরঞ্জিত প্রোপাগান্ডা।
চতুর্থ প্যারা--
“সূত্রমতে, এক সময় সরকারকে বিপদে ফেলতে নিজেই অজ্ঞাত স্থান থেকে গুম হয়ে যান। অবশেষে গোপনে বর্ডার পার হয়ে ভারতের সবচেয়ে নান্দনিক, নিরাপদ ও উপভোগ্য স্থান মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে গিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন।”
সবচেয়ে ভয়াবহ ও নোংরা মিথ্যাচারটি করা হয়েছে এখানে। ২০১৫ সালের ২৩ মে ভারতের ‘দ্য ওয়্যার’ সংবাদমাধ্যমে “Anatomy of a Disappearance, and a Reappearance” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান এবং মুক্তাদির আল রশীদের অনুসন্ধানে উঠে আসে কিভাবে বাংলাদেশের সরকারি আইনশৃংখলাবাহিনী সালাহউদ্দিনকে তার গুলশানের একটি বাড়ি থেকে গোপনে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এবং তার কিছুদিন পরেই তাকে ভারতের শিলংয়ে একটি রেল স্টেশনের পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। এ নিয়ে ‘দ্য ওয়্যারের’ আগে বাংলাদেশের নিউজ এইজ পত্রিকায়ও অনুসন্ধানি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। Understanding Salah Uddin’s disappearance
সেই অপহরণকেই বাংলানউজ বলছে “সরকারকে বিপদে ফেলতে নিজেই অজ্ঞাত স্থান থেকে গুম হয়ে যান”!
পঞ্চম প্যারা--
“বাংলাদেশ সরকারকে বিব্রত করার পাশাপাশি ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের কাজটিও করে ফেলেন সালাহউদ্দিন। যার ফলে কাগজপত্র ছাড়া অনুপ্রবেশের অপরাধে গ্রেপ্তার হলেও ভারত সরকারের অনুকম্পায় জামিনে মুক্ত হয়ে সরকারি কটেজে অবস্থান করছেন।”
এই প্যারায় ‘ভারত সরকারের’ শব্দদ্বয়ের পরে ‘অনুকম্পায়’ শব্দটির ব্যবহার দৃষ্টি আকর্ষণীয়। পার্শ্ববর্তী একটি দেশের সাবেক এক মন্ত্রী গুম হয়ে অপহৃত অবস্থায় ভারতের সীমান্তে ঢুকে যাওয়ার পর তার সাথে আইনগত আচরণ করাটা বাংলানিউজের কাছে ‘অনুকম্পা’ প্রদর্শন ঠেকেছে! তাকে ওখানে আবার ভারত সরকার গুম করে ফেললে হয়তো বাংলানিউজ সেটিকে ‘স্বাভাবিক আচরণ’ বলতো! একই সাথে বাংলানিউজ গুম হয়ে অপহৃত সালাউদ্দিনের কাছে কেন ‘কাগজপত্র’ নাই সেই প্রশ্ন তুলছে এবং অপহরণকারীদের দ্বারা সীমান্ত পার হতে বাধ্য হওয়াকে ‘অনুপ্রবেশের অপরাধ’ বলছে!
ষষ্ঠ প্যারা--
“কারো কারো মতে, খালেদা জিয়া আসলে সালাহউদ্দিনকে দিয়ে বড় ধরনের গেম খেলতে চেয়েছিলেন। তাকে দিয়ে গুমের নাটক সাজিয়ে সরকারকে বিপদে ফেলাই তার লক্ষ্য ছিল।”
একাধিক দেশি বিদেশী সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে প্রমাণিত একটি গুমের ঘটনাকে কিভাবে উল্টিয়ে সেটিকে বিরোধী দলের নেত্রীর বিরুদ্ধে ‘গেম খেলা’র অভিযোগ হিসেবে দাঁড় করানো যায় তার একটি নির্মম উদাহরণ এই প্যারাটি। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের বিরুদ্ধে এমন ‘কারো কারো মতে’র বরাতে মিথ্যাচার করা আইনত বড় ধরনের মানহানির অপরাধ। কিন্তু বাংলানিউজ সরকারি দলের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে নির্ভয়ে এমন মানহানিকর বক্তব্য প্রচার করে যাচ্ছে।
সপ্তম প্যারা--
“সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনা যাই ঘটুক। মাঝখান থেকে লাভবান হয়েছেন সালাহউদ্দিন নিজেই। এক সময় সরকারের একজন কর্মচারী হিসেবে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির এমপি-মন্ত্রী এমনকি মাঝারি মানের নেতাদেরকেও জ্বি ম্যাডাম, জ্বি স্যার বলতে বলতে যিনি মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলতেন, সেই তিনিই এখন খালেদা জিয়ার পাশের চেয়ারে বসবেন। আর দলের অনেক যোগ্য, পরিক্ষীত, প্রবীণ, প্রাজ্ঞ নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদের পেছনে বসে তার ক্যারিশমাটিক উত্থান চেয়ে চেয়ে দেখবেন।”
“জ্বি ম্যাডাম, জ্বি স্যার বলতে বলতে যিনি মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলতেন” এই ধরনের ভাষা সংবাদমাধ্যমের ভাষা তো নয়ই, প্রচলিত মুখের ভাষা হিসেবেও অত্যন্ত ইতর শ্রেণীর।
বাংলাদেশ সরকার যখন ‘অসাংবাদিকতাসুলভ’ আচরণের অভিযোগে এক সাথে ৩৫টি অনলাইন সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন সরকারের স্বার্থ রক্ষা করে এবং সরকারের বিরোধীদের ঘায়েল করার ইচ্ছা থেকে বাংলানিউজের মতো চরম মিথ্যাচার এবং নোংরামি করে রিপোর্ট প্রকাশ করলে তা ‘অসাংবাদিকতাসুলভ’ বলে বিবেচিত হচ্ছে না! এটাই বর্তমান বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জগতের একটি বাস্তবতা।
বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত
উত্তরমুছুনধন্যবাদ আপনাকে।
উত্তরমুছুন