সোমবার, মে ০১, ২০১৭

সাংবাদিক গ্রেফতার: সংবাদমাধ্যমে নীরবতা!


একজন সিনিয়র সাংবাদিককে গ্রেফতার করে এক দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। বাংলাট্রিবিউনের এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে--

"তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় নতুন সময় ডট কমের নির্বাহী সম্পাদক আহমেদ রাজুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার (১ মে) ঢাকা মহানগর হাকিম একেএম মইন উদ্দিন সিদ্দিকী এই আসামির জামিনের আবেদন নাকচ করে তার একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।"


রোববার রাতে গ্রেফতার করা এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অভিযোগটা কী? এ বিষয়ে অভিযোগকারী ওয়ালটন গ্রুপের মালিকানাধীন অনলাইন নিউজ পোর্টাাল রাইজিংবিডি'তে বলা হয়েছে--

"সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নিজেদের অনলাইন মাধ্যমে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা, বানোয়াট ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে দেশীয় ব্র্যান্ড ও দেশীয় শিল্পের ক্ষতি সাধনের অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রমনা থানার ওসি (তদন্ত) আলী হোসেন জানান, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেকেই অন্যের ক্ষতি করার অপচেষ্টা করে থাকে। এক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তদন্তপূর্বক বিস্তারিত জানা যাবে।"

রাইজিংবিডি'র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, "প্রসঙ্গত, অনলাইন নিউজ পোর্টাল নতুন সময় ডটকমে দেশের শীর্ষস্থানীয় ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইলস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও টেলিকমিউনিকেশন পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন-এর নিজস্ব ব্র্যান্ড ‘ওয়ালটন’ মোবাইল ফোনসেট নিয়ে মিথ্যা তথ্যনির্ভর একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন প্রকাশের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হয়, যা দেশীয় ব্র্যান্ড ও দেশীয় শিল্পের ক্ষতি সাধনের অপচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন মহলে চিহ্নিত হয়েছে।"

লিংক: http://www.risingbd.com/law-crime-news/224167

মজার বিষয় হল, রোববার দিবাগত রাতে গ্রেফতার হওয়া এবং সোমবার দিনে আদালতে তোলার পর রিমান্ড মঞ্জুর হওয়া- এসব ঘটনা নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে কোনো খবর প্রকাশিত হচ্ছে না! অনলাইনে খুঁজে দেখা গেছে, বাংলাট্রিবিউন, দ্যা রিপোর্ট, ঢাকাটাইমস, রাইজিংবিডি- এই কয়েকটি উল্লেখ করার মতো পোর্টালে সংবাদটি এসেছে। এর মধ্যে রাইজিংবিডির প্রতিবেদনে অভিযোগকারী ওয়ালটনের 'মনের মতো' বক্তব্য জুড়ে দেয়া হয়েছে।

ওয়ালটনের দায়ের করা মামলায় যে অভিযোগগুলোর কথা বলা হয়েছে (উপরে রাইজিংবিডির রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত অংশ দ্রষ্টব্য) সেগুলো অস্পষ্ট। কোন সংবাদের ভিত্তিতে এমন অভিযোগ- তার উল্লেখ নেই। এ জন্য নতনুসময় ডটকমের ওয়েবসাইটে ঘাঁটতে হল। গত এক সপ্তাহে ওয়ালটন নিয়ে অভিযোগমূলক ৩টি সংবাদ পোর্টালটিতে পাওয়া গেছে।

প্রথম স্টোরিটি প্রকাশ হয় ২৩ এপ্রিল। শিরোনাম "ওয়ালটন মোবাইল ক্রেতাদের গলার কাঁটা"। এখানে মূলত সামাজিক মাধ্যম ও এর বাইরে ওয়ালটনের ভোক্তাদের কয়েকজনের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ভোক্তারা কিভাবে কোম্পানিটির পণ্য কিনে নানাভাবে হয়রানির বা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। এই রিপোর্টে কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত বা এ ধরনের কিছু নেয়া হয়নি। অবশ্য অভিযোগের বিষয়ের ওয়ালটন কর্তৃপক্ষের বক্তব্য আছে।

২৪ এপ্রিল একটি ফলোআপ করে নতুনসময় ডটকম। শিরোনাম, "ওয়ালটন মোবাইলের ভোগান্তি, ক্ষোভে উত্তাল ফেসবুক"। আগের দিনের রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক মাধ্যমে যেসব মন্তব্যে ওয়ালটনের বিপক্ষে অভিযোগ করা হয়েছে সে ধরনের কিছু মন্তব্য (স্ক্রীনশটসহ) তুলে দেয়া হয়েছে।

এরপর ২৬ এপ্রিল: "ক্রেতাদের ক্ষোভ, যন্ত্রণার বাক্স ওয়ালটন টিভি" শিরোনামে আরেকটি রিপোর্ট করা হয়। সেখানেও কয়েকজন ভোক্তার অভিযোগের একটি 'সংকলন' তুলে ধরা হয়। এই রিপোর্টে ওয়ালটন কর্তৃপক্ষে বক্তব্যের পাশাপাশি বুয়েটের একজন অধ্যাপকের বক্তব্যও আছে। তিনি কোম্পানিটির নাম উল্লেখ করেই তাদের পন্যে ত্রুটি থাকার বিষয়টি বলেছেন, সাথে তার কারণও বলেছেন।

সাংবাদিকতার মানদণ্ডে এই তিনটি রিপোর্ট একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। মোটামুটি মানের রিপোর্ট হয়েছে। আরও ভাল রিপোর্ট হিসেবে তৈরি করতে নানা ধরনের বিশেষজ্ঞের মতামত, বাজারে থাকা একই ধরনের কোম্পানির একই ধরনের পন্যের মানের তুলনামূলক কোনো পরিসংখ্যান থাকলে তা উল্লেখ করা, গণমাধ্যমে আগে এ ধরনের আরও অভিযোগ ছিল কিনা তার রেফারেন্স দেয়া, আরও স্পেসিফিক অভিযোগ তুলে আনা, আরও শক্ত প্রমাণ দেয়া, কর্তৃপক্ষের আরো বক্তব্য নেয়া- ইত্যাদি করা যেতে পারতো। এতে রিপোর্টিগুলোর মান আরো বাড়তো।

কিন্তু তারপরও বলা যায়, রিপোর্টগুলোতে যে একেবারে কোনো অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি তা নয়। অবশ্য তথ্যভিত্তিক হওয়ার পরেও যে কোনো বক্ত্যব্য বা সংবাদপ্রতিবেদনকে 'উদ্দেশ্যমূলক' বলা যেতেই পারে। প্রতিটি কাজেরই উদ্দেশ্য থাকে। এই রিপোর্টগুলোর পেছনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল কিনা তা এখনই নিশ্চিত করে বলার সুযোগ নেই। তদন্তকারীরা তদন্ত শেষে বলতে পারবেন। তবে এখানে উল্লেখ্য, আহমেদ রাজুর বিরুদ্ধে ওয়ালটনের মালিকানাধীন নিউজ পোর্টালেও (রাইজিংবিডি) এইসব প্রতিবেদনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি বা এরকম কিছুর অভিযোগ করা হয়নি।

বরং অভিযোগ হিসেবে রাইজিংবিডির রিপোর্টে উল্লেখ করা- "যা দেশীয় ব্র্যান্ড ও দেশীয় শিল্পের ক্ষতি সাধনের অপচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন মহলে চিহ্নিত হয়েছে" বাক্যাংশটি বলে দেয় নতুনসময়ের রিপোর্টগুলোর বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়ানোর মতো কিছু ওয়ালটনের হাতে নেই। তাই 'দেশীয় পণ্য-দেশীয় শিল্প' ইত্যাদি আবেগের দোহাই দিতে হচ্ছে কোম্পানিটিকে।

এই ধরনের অস্পষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে করা মামলার প্রাথমিক তদন্ত না করে (উপরে রমনা থানার ওসির বক্তব্যে এখনো প্রাথমিক তদন্ত না করার বিষয়টি স্পষ্ট) অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা এবং আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ থাকছে।

তার চেয়েছ বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যদি আহমেদ রাজু সত্যিকারের কোনো অপরাধ করে থাকেন, বা তিনি 'দেশীয় পণ্য উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র' করেই থাকেন, তাহলেও তার গ্রেফতার ও রিমান্ড মঞ্জুরের খবরটি কেন মূলধারার মিডিয়া প্রকাশ করছে না? আইসিটি মামলায় সাধারণ কোনো ব্যক্তি গ্রেফতার হলেও তো তা নিয়ে সংবাদপ্রতিবেদন ছাপা হয়। তাহলে একজন সিনিয়র সাংবাদিকের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম করছে কেন সংবাদমাধ্যমগুলো? 'সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা', 'বাকস্বাধীনতা' ইত্যাদি বিষয় কি করপোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি? কোনো ঘটনার 'সংবাদমূল্য'ও কি কোম্পানিগুলোই নির্ধারণ করছে এখন?

নতুন সময়ের তিনটি রিপোটের লিংক-







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন