শনিবার, জানুয়ারী ২০, ২০১৮

বাংলাদেশকে ‘ভারতের চেয়ে সাম্প্রদায়িক’ দেখাতে চায় কারা?


//বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের চিত্র খুবই ভয়াবহ। বিশেষ করে হিন্দুরা এখানে প্রতিদিন মার খাচ্ছে। তাদেরকে বাড়িঘরছাড়া করে ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।//

এই প্রচারণাটা ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে এবং ভারতে উভয় জায়গায় চালানো হয়। বাংলাদেশে বসে দিল্লিতে বাস করা কিছু লোকও এই সুরে জিগির করে থাকেন। এবং এই মুহূর্তে চলমান প্রণব মুখার্জির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার বাংলাদেশি নেতাদের ছবি তোলা বিতর্কের সময়ও এই জিগির চালানো হচ্ছে। প্রণবের বাংলাদেশি ভক্ত-মুরিদানরা বলছেন, এই ছবির সমালোচনা নাকি সংখ্যালঘু বিদ্বেষ, হিন্দুবিদ্বেষ থেকে হচ্ছে!


তো, উল্লেখিত ছবির সমালোচনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মানুষকে আবারও হিন্দুবিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক বলে চিহ্নিত করতে মশগুল হলেও এই লোকেরাই সীমান্তের ওপারের সাম্প্রদায়িকতার, সংখ্যালঘু নিপীড়নের চিত্রটা নিয়ে আলাপ করতে চাননা। আর আলোচনা না হওয়ার কারণে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, আসলেই বাংলাদেশের মানুষ খুবই সাম্প্রদায়িক, সংখ্যালঘুবিদ্বেষী। (এবং প্রণবের ইস্যুটাকেও তারা সাম্প্রদায়িক নজরেই বিচার করছে!)

প্রচারণাকারীদের ভাবখানা এমন- বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা ভারতের সংখ্যালঘুদের চেয়ে খুবই খারাপ আছে। এই জন্যে উদ্বেগ শুধু বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে দেখাতে হবে, ভারত নিয়ে উদ্বেগ দেখানোর কিছু নাই!

ভারতেও একই প্রচারণা চলে। এমন প্রচারণার শিকার হয়ে ভারতের সাধারণ মানুষজন বাংলাদেশের মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবে না দেখে ‘মুসলমান’ হিসেবে দেখে; যারা হিন্দুদের নির্যাতন করে!

এবং এ কারণেই আসামে বা পশ্চিমবঙ্গে ‘মুসলমান’ হলেই তাকে ‘বাংলাদেশি’ বলে সন্দেহ করা হয়! কিন্তু একই পরিস্থিতিতে কেউ নিজেকে ‘বাংলাদেশি হিন্দু’ বলে প্রমাণ করতে পারলে সে ভারতীয়দের কাছে আদরণীয় হয়ে ওঠে।

কারণ ওই যে, আগে থেকে তাদেরকে বলে রাখা হয়েছে- বাংলাদেশের হিন্দুরা খুবই ভয়াবহভাবে নির্যাতনের শিকার। নিজধর্মের নির্যাতিত অনুসারীকে সাদরে গ্রহণ করা খুবই স্বাভাবিক। এবং যাদের হাতে ‘নির্যাতিত’ হয়েছে সেই ‘মুসলমান’ পরিচয়ের প্রতি ঘৃণা জন্মানোও স্বাভাবিক।

২.

বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের কোনো দেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত-নিপীড়িত হয় না- এমনটা বলার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশেও হয় কমবেশি।

কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘুদের চেয়ে, বিশেষ করে মুসলমানদের চেয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে হিন্দুরা অন্তত ‘১০০ গুণ’ বেশি ভাল আছেন।

বাংলাদেশের পরিস্থিতি (ভারতের চেয়ে) এতটাই ভাল যে, এখানে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক কোনো কথা প্রকাশ্যে কেউ বলার সাহস পায় না; কোনো নেতা তো নয়ই। কোনো জায়গায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারো ওপর নিপীড়নের ঘটনা ঘটলে, এবং দোষী ব্যক্তিটি মুসলমান হলে তার ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে তাকে ডিফেন্ড করে  প্রকাশ্যে কেউ কোনো বক্তব্য দিতে যায় না। (হয়তোবা কোনো বিকারগ্রস্ত লোক হিন্দুদের ওপর হামলার কারণে মনে মনে খুশি হয়ে থাকতে পারে, অথবা একান্ত নিজস্ব পরিসরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পক্ষে কথা বলতে পারে। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস পায় না। ) বিগত অন্তত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি প্রকাশ্যে কোনো ধর্ম বা উপজাতি গোষ্ঠির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিয়েছেন এমন নজির মনে পড়ে না।

কিন্তু ভারতের চিত্র দেখুন ঠিক উল্টো। ওখানে প্রকাশ্যে মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণ এবং দেশছাড়া করার হুমকি দেন মন্ত্রী-এমপি-সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। এবং এজন্য হুমকিদাতাদেরকে প্রায়ই সরকারিভাবে পুরস্কৃত করা হয়!

বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথকে ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী করে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। উগ্রপন্থী এই ব্যক্তি কট্টরভাবে মুসলিম ও খ্রিষ্টানবিরোধী। ২০০৫ সালে তিনি তার অঞ্চলের খ্রিষ্টানদেরকে বলপ্রয়োগ করে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার একটি উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন। (সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া) 

এছাড়া মুসলিমদের প্রতি তার প্রকাশ্য বিদ্বেষমূলক অসংখ্যক বক্তব্য কার্যক্রম রয়েছে। ২০১৬ সালে ভারতে হিন্দুধর্মরীতি মেনে যোগব্যায়াম করা বাধ্যতামূলক করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। এসময় মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় কারণে এর বিরোধিতা করলে আদিত্যনাথ বলেছিলেন, যারা সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যোগব্যয়ামে হিন্দুরীতি অনুসরণ করতে পারবে না তারা যেন ভারত ছেড়ে চলে যায়।

২০১৫ সালে যোগীর উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে তার জুনিয়র এক নেতা প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়ে বলে, “মৃত মুসলিম নারীদের দেহ কবর থেকে তুলে ধর্ষণ করতে হবে।” ওই নেতাকে থামাননি আদিত্যনাথ। কয়েকদিন পরে তিনি আরেক অনুষ্ঠানে বলেন, “হিন্দুরা জন্মগতভাবে উদারপন্থী এবং এ কারণে ভারতও উদারপন্থী। ভারতের মুসলমানরা সারা বিশ্বে মধ্যে সবচেয়ে শান্তিতে আছে।” (সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট)

২০১৪ সালে এক সমাবেশে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, “মুসলমানরা একজন হিন্দুকে হত্যা করলে আমি ১০০ জনকে হত্যা করবো। তারা একটা হিন্দু মেয়েকে (বিয়ের জন্য) নিয়ে গেলে, আমি তাদের ১০০টি মেয়ে নিয়ে যাবো।”

এমন শত বক্তব্য আছে যোগী আদিত্যনাথের। এবং এসব উস্কানিমূলক ঘৃণা ছড়িয়ে পুরস্কার হিসেবে রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রীর পদ পেয়েছেন ভারতে!

অথচ, কল্পণা করুন, অথবা স্মরণ করার চেষ্টা করুন- বছরের পর বছর তো নয়ই, একবারের জন্য বাংলাদেশে প্রকাশ্যে এমন হিন্দুবিদ্বেষী কথা বলেছেন কোনো ক্ষমতাসীন দলের নেতার নাম জানা আছে আপনার? অন্তত গত বিশ বছরে এমন কারো কথা মনে পড়ে? এমনকি কোনো ইসলামী রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক দলের নেতা হিন্দুদেরকে এমন প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি, ধর্ষণের হুমকি দিয়েছেন কখনো?

আদিত্যনাথ ভারতের রাজনীতিতে কোনো ব্যতিক্রম চরিত্র নন। খোদ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে গুজরাটে মুসলিম হত্যার সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ আছে। অবশ্য তা প্রকাশ্য ছিলো না।

প্রকাশ্য জনসভায় বা মিডিয়ায় ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক উগ্র কথাবার্তা বলা সাম্প্রতিক শীর্ষ কয়েকজন নেতার তালিকা দেই।

২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শিবসেনা তাদের নিজস্ব পত্রিকা ‘সামনা’তে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘ভারতের মুসলমানরা ভারতে থাকতে চাইলে বন্দেমাতরম বলে থাকতে হবে। নিজেদের ধর্ম আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইলে তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরার করার নিশ্চয়তা চাইতে পারে না।”  (সুত্র: ইন্ডিয়া টুডে)

বাংলাদেশে কোনো নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনও হিন্দুদেরকে তাদের ধর্ম ছেড়ে মুসলিমদের রীতিনীতি বা কালচার মেনে চলতে বাধ্য করার এমন প্রকাশ্য ঘোষণা কখনো দেয়নি। অথচ শিবসেনা ভারতের কোনো নিষিদ্ধ সংগঠন নয়। বরং বর্তমান ক্ষমতায় থাকা National Democratic Alliance এর অন্যতম শরিক দল। এই শিবসেনাদের মনোনয়নেই নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

চলতি জানুয়ারির (২০১৮ সাল) ১৪ তারিখ উত্তর প্রদেশের এমএলএ এবং বিজেপি নেতা সুরেন্দ্র সিং বলেছেন, ভারতে শুধু ওই মুসলমানরাই থাকতে পারবে যারা হিন্দু সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারবে।” (সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস) 

২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর আসামের গভর্নর পিবি আচার্য বলেছিলেন, “ভারত শুধু হিন্দুদের জন্য। মুসলমানরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী পাকিস্তান কিম্বা বাংলাদেশে চলে যেতে পারে।” সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস।

গত বছরের (২০১৭) ১৪ ডিসেম্বর বিবিসি, সিএনএন, এএফপি, রয়টার্স সহ বিশ্বের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য মিডিয়া সংবাদ প্রকাশ করে- ভারতে এক হিন্দু ব্যক্তি একজন মুসলমানকে হত্যার পর  লাশ পুড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে। এরপর সেই ভিডিও অনলাইনে ছেড়ে দিয়ে মুসলিমবিরোধী একটি ক্যাম্পেইনের জন্য লোকজনের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ শুরু করে। অনেকে অনুদান দিচ্ছিলেনও! সে সাংবাদিকদের জানিয়েছে, এমনটি করার মাধ্যমে সে একজন ‘হিন্দু হিরো’ হতে চেয়েছে।

বাংলাদেশে এমন কোনো বর্বর দৃশ্যের অবতারণা হওয়ার সুযোগ অন্তত নিকট ভবিষ্যতে নেই। কারণ এখানকার সবচেয়ে বড় হিন্দুবিদ্বেষী লোকটিও জানে, এমন কোনো বর্বরতাকে বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমানরা ‘বীরত্ব’ হিসেবে নয়, বরং ‘কুলাঙ্গারি কাজ’ হিসেবে নেবে, এবং তার শাস্তি কামনা করবে। কিন্তু ভারতের ওই লোকটি জানতো তার আশপাশের মানুষের মধ্যে সে ‘বীর’ হিসেবে গণ্য হওয়ার সুযোগ আছে। (সূত্র: নিউজউইক)

এখানে মাত্র কয়েকটা উদাহরণ তুলে দেয়া হলো। প্রতিদিন ভারতে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এমন বহু উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এবং এসবের মধ্যেই বাস করতে হচ্ছে সেখান মুসলিমসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদেরকে।

শেষ করার আগে ভারত সরকারের প্রকাশিত কয়েকটি তথ্য দেয়া যাক। ২০১৬ সালে ৭০০টির বেশি সাম্প্রদায়িক হামলার শিকার হয়েছে সংখ্যালঘুরা। এসব ঘটনায় ৮৬ জন খুন হয়েছেন, আহত হয়েছেন আড়াই হাজার মানুষ। মুম্বাই ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সিএসএসএস’র মতে, সাম্প্রদায়িক হামলা ও হতাহতের ঘটনা সরকারি সংখ্যার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন