শুক্রবার, মার্চ ০৯, ২০১৮

নারীকে নিয়ে রাজনীতি: হেফাজতি নিপীড়ন ও আওয়ামী নিপীড়নে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া



বাংলাদেশের বর্তমান আদর্শিক বিভাজনের রাজনীতির অন্যতম দুটি পক্ষ হলো- এক. ‌‘ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারিজম’ এবং; দুই: ‘ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারিজম-বিদ্বেষী ইসলামিজম’। অর্থাৎ, এখানকার সেকুলারদের মূলধারা ইসলামবিদ্বেষী। আর তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণকারী ইসলামপন্থি নানা গ্রুপ মিলে আরেকটি ধারা; যারা নিজেদের মধ্যে নানাভাবে বিভাজিত হলেও ইসলামবিদ্বেষীদের ব্যাপারে মানসিকভাবে ঐক্যবদ্ধ।

সার্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশের মিডিয়া স্বাধীনও নয়, এবং লিবারালও নয়। আবার এখানকার সরকারও ইলিবারাল, এবং ‘ইসলামবিদ্বেষী সেকুলাররা’ এই সরকারের মেশিনারিতে প্রভাশালী হিসেবে বসে আছেন। অর্থাৎ, ইলিবারাল মিডিয়াকে ইলিবারাল সরকারে থাকা ‘ইসলামবিদ্বেষী সেকুলাররা’ ডিক্টেট করার সুযোগ পান। এইটাই বাংলাদেশের মিডিয়া পরিস্থিতি।


তাহলে সহজেই বুঝা যায় এই বাস্তবতায় ‘সেকুলার ইসলামবিদ্বেষীদের’ বিপরীত মেরুতে থাকা ‘নানা পন্থি ইসলামপন্থিদের’ ভয়েস কতটা শোনা যাবে, বা কতটা সাপ্রেস হবে, কিম্বা কতটা তাদের উপর আরোপ করা হবে।

একইসাথে পাল্টাটাও বুঝা যায়। ‘ইসলামপন্থি সেকুলারদের’র ভয়েস কতটা বড় করে তুলে ধরা হবে, কতা প্রিভিলিজ দেয়া হবে তাদেরকে।

এখানে এমনই একটা ক্লাসিক উদাহরণ তুলে ধরবো। উপলক্ষ হচ্ছে ‘নারী নিপীড়ন’। ‘ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারদের ছাতা’ আওয়ামী লীগের হাতে নারী নিপীড়িত হলে মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি সেটাকে কিভাবে দেখে এবং দেখায়, আর ‘সেকুলারবিদ্বেষীদের ছাতা’ হেফাজতে ইসলামের (সংগঠন হেফাজত এখানে মূখ্য নয়, হেফাজতের বোধকে ধারণ করা মূখ্য) হাতে নারী নিপীড়িত হলে মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটি সেটাকে কিভাবে দেখে এবং দেখায়।

২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ হয়েছিল। সেটি কভার করতে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম থেকে পাঠানো হয়েছিলো কয়েকজন নারী সাংবাদিককে। তারা সেখানে নানাভাবে নিপীড়নের শিকার হন। নিপীড়ন বলতে এখানে ‘হামলা করে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত করা’কে বুঝানো হয়েছে। এ নিয়ে পরের দিনগুলিতে সংবাদমাধ্যমও সিভিল সোসাইটি এতটাই সরব ছিল যে, হেফাজতের সমাবেশস্থলেই পাল্টা সমাবেশ ডেকেছিলো কয়েকটি নারী ও সাংবাদিক সংগঠন। এছাড়া বেশ কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, বিবৃতি, কলাম লেখা, টকশোতে আলোচনা হয়েছিল ‘হেফাজতের নারী নিপীড়ন’ নিয়ে।

সেরকম কয়েকটি সংবাদের লিংক ও স্ক্রিনশট এখানে দেয়া হল--










এবার দেখুন গত ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলের আশপাশের রাস্তায় সমাবেশে আগতদের হাতে নারী নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশি মিডিয়া ও সিভিল সোসাইটির অবস্থান। সন্ধ্যা পর্যন্ত সমাবেশ চলাকালে এবং শেষে ফেসবুকে অন্তত ডজনখানেক নারীর পোস্ট ভাইরাল হয়। তারা সবাই আওয়ামী লীগ কর্মীদের হাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সহকারে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেন। হাজার হাজার বার একেকটি পোস্ট শেয়ার হলেও, এবং দলমত নির্বিশেষে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীরা-‘ফেসবুক সেলিব্রিটিরা’ এ নিয়ে পোস্ট দিলেও মিডিয়াতে উঠতে পারেনি এই খবর! পরের দিনের পত্রিকাও বলতে গেলে ব্লাকআউট এটি!

রাস্তাঘাটে নারীর যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নিয়ে যে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করে না তা নয়। এই গবেষণা ভিত্তিক রিপোর্ট ৬ মার্চ সব সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছিল। কিন্তু মাত্র পরের দিনই আওয়ামী লীগের সমাবেশে এর চেয়েও বড় ধরনের হয়রানি নিয়ে চুপ! 
অথচ মাত্র একটি ছবি/ঘটনা ভাইরাল হলে অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলো তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এক ডজন নারী তাদের যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতা ফেসবুকের পাবলিক পোস্টে জানালে কত নারী যে ওই দিন একই ধরনের ঘটনা শিকার হয়েও কাউকে বলেননি, বা ফেসবুকে লিখেননি তা সহজেই অনুমেয়। নারী নিপীড়নের এমন স্কেল সম্পর্কে ধারণা করার পরও বাংলাদেশের ইলিবারাল ও পরাধীন মিডিয়া তা এড়িয়ে গেছে। এটা সেলফ সেন্সরশিপ, নাকি সরকার আরোপিত সেন্সরশিপ তা শুধু মিডিয়াই জানে।

মজার ও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, পরের দিন ৮ মার্চ নারী দিবসে ‘নারীর অধিকার’ নিয়ে কিন্তু খুবই সরব ছিলো পত্রিকা-টিভি ও অনলাইন সংবাদমাধ্যগুলো! ‘ইসলামবিদ্বেষী সেকুলারদের ছাতা’ আওয়ামী লীগের কর্মীদের হাতে গণহারে নারী নিপড়নের ঘটনা খবর হয়ে না ওঠায় আক্ষেপ করেছেন সিনিয়র একজন সাংবাদিক ও সম্পাদক।

৮ মার্চ রাতে বেসরকারি টেলিভিশন ‘ডিবিসি’ এর ‘যৌন হয়রানি: ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়’ শীর্ষক টক শোতে তিনি মিডিয়ার নীরবতার সমালোচনা করেন। তার উদ্ধৃতি উল্লেখ করার আগে ডিবিসির টকশোটির নামকরণের দিকে নজর দিতে পারেন। গণহারে নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনাকে ‘ফেসুবক’ এর বরাতে জানাচ্ছে টিভি স্টেশনটি। মিডিয়াতে সংবাদ নাই, সিভিল সোসাইটিতে প্রতিবাদ নাই। তাই ‘ফেসবুকে ঝড়’ই আলোচনার বিষয়বস্তু।

ডিবিসির টকশোতে গোলাম মোর্তজা
শোতে হাজির হয়ে মিডিয়ার সমালোচনা করে সাংবাদিক গোলাম মোর্তজা যা বলেছেন ঢাকাটাইমস এর প্রতিবেদন থেকে তা তুলে ধরছি--

“আওয়ামী লীগের ৭ মার্চের মিছিল থেকে যৌন হয়রানির অভিযোগের খবর প্রকাশে মূলধারার গণমাধ্যম দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে বলে মনে করেন সাপ্তাহিকের সম্পাদক গোলাম মোর্তজা। তার মতে কোনো কোনো ঘটনায় গণমাধ্যম বিস্ময়কর দুর্বলতার পরিচয় দেয়, এর একটি হলো ৭ মার্চের ঘটনা। এই ঘটনা আলোচনায় আসার পেছনে মূল ভূমিকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রেখেছে বলে মনে করেন তিনি।

বৃহস্পতিবার রাতে একটি টেলিভিশন টক শোতে অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। ডিবিসি টেলিভিশনে ‘যৌন হয়রানি: ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়’ শীর্ষক টক শোতে তার সঙ্গে ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন শারমিন চৌধুরী।”

“এই ঘটনার সংবাদ পরিবেশনে গণমাধ্যমের দুর্বলতার কথা তুলে ধরে সাপ্তাহিকের সম্পাদক গোলাম মোর্তুজা বলেন, ‘গণমাধ্যম কিছু কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর দুর্বলতার পরিচয় দেয়। সেই দুর্বলতার একটি পরিচয় কিন্তু গতকালকে (বুধবার) দিয়ে দিল। একজন নির্যাতিত কিশোরী যখন ফেসবুকে এরকম নির্যাতনের কাহিনি লিখলো তখন একদল মানুষ প্রমাণ করার চেষ্টায় লিপ্ত হলো এটা একটি ফেইক আইডি। একদল মানুষ প্রমাণ করার চেষ্টায় লিপ্ত হলো যে এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এটা কিন্তু সারারাত ধরে চললো। আমার জানামতে সেই সময় গণমাধ্যমের কেউ এগিয়ে আসেনি বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য যে, এটি ফেইক আইডি নাকি এটি সঠিক আইডি। মেয়েটি ঠিক বলছে কি না, এরকম ঘটনা ঘটেছে কি ঘটেনি। এই জায়গায় গণমাধ্যমের চূড়ান্ত রকমের ব্যর্থতা।”

“এই সাংবাদিক বলেন, ‘প্রিন্ট মিডিয়ায়, আজকের যে প্রিন্ট মিডিয়া, যেটা প্রকাশিত হয়েছে, সেই প্রিন্ট মিডিয়ার প্রায় সবগুলোতে এ ধরনের সংবাদ নেই। এটাও গণমাধ্যমের বড় রকমের দুর্বলতা।”

অনলাইনে দুয়েকটি সংবাদমাধ্যম যে ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়। যেমন বাংলাট্রিবিউন এ ঘটনা নিয়ে বুধবার রাতে প্রথমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে “সোহরাওয়ার্দীর জনসভার আশেপাশে নারী হয়রানির অভিযোগ ফেসবুকে ভাইরাল” শিরোনামে। পরের দিন আবারও “জনসভার জনস্রোতে যৌন হয়রানি” শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে অনলাইন পত্রিকাটি।

এর বাইরে ৮ মার্চে প্রথম আলোর প্রিন্ট ভার্সনে “মিছিল থেকে হয়রানির অভিযোগ” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। যদিও অনলাইনে আগের দিন এ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি পত্রিকাটি। পরের দিনও অন্য কোনো প্রতিবেদন দেখা যায়নি।

অবশ্য রিপোর্ট প্রকাশ করেও প্রথম আলো একটি ‌‌‘বড় অপরাধ’ (আইনের ‍দৃষ্টিতে) করেছে। সেটি হলো একজন ভিকটিমের ফেসবুক পোস্ট থেকে উদ্ধৃ করা বক্তব্যের একটি অংশ বাদ দিয়ে সেটিকে বিকৃত করেছে। এবং এই বিকৃতিটাও ‘সেকুলার ইসলামবিদ্বেষীদের ছাতা’ আওয়ামী লীগকে সুবিধা দেয়ার জন্য বলেই মনে হচ্ছে।

ভিকটিম লিখেছিলেন, “জয় বাংলা বলে যারা মেয়ে মলেস্ট করে, তাদের দেশে আমি থাকব না...থাকব না...থাকব না।” প্রথম আলো ‘জয় বাংলা বলে’ অংশটুকু বাদ দিয়ে লিখেছে “যারা মেয়ে মলেস্ট করে, তাদের দেশে আমি থাকব না...থাকব না...থাকব না।” ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি স্বাধীনতা যুদ্ধে আগে-পরে সার্বজনীনভাবে ব্যবহৃত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ নিজেই এটিকে দলীয় স্লোগানে পরিণত করেছে।

ভিকটিমের উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট হয় আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলের আশপাশে চলাচলের সময় কাদের দ্বারা তিনি নিপীড়িত হয়েছিলেন। কিন্তু প্রথম আলো তার লাখো পাঠকের কাঠগড়া থেকে আওয়ামী লীগ কর্মীদেরকে মুক্তি দিয়ে দিল!

ডেইলি স্টার ৮ মার্চের পত্রিকায় ‍“On Facebook, they open up: Several women allege sexual harassment on Dhaka streets” শিরোনামে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।

মূলত এই তিনটি মূলধারার পত্রিকায়ই রিপোর্ট পেয়েছি। এর বাইরে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলে আশপাশে যৌন হয়রানি নিয়ে প্রতিবেদন মূলধারার অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে চোখে পড়েনি। আমি পত্রিকা বা পোর্টাল ধরে ধরে নিউজ খুঁজিনি। গুগলে নানা কীওয়ার্ড দিয়ে খুঁজেছি। ফলে দুয়েকটি পত্রিকার রিপোর্ট মিস হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ জন্য দুঃখিত।

(আর হ্যাঁ, সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক-সমালোচনা প্রেক্ষিতে সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং এরপর ৮ মার্চ রাতে একজন ভিকটিমের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের- এসব ফলোআপ সংবাদ পাওয়া যাবে নানা সংবাদমাধ্যমে। আমার আলোচনা এই ‘বাধ্যতামূলক ফলোআপ’ সংবাদ প্রতিবেদন নিয়ে নয়।)

এটা গেল মিডিয়ার নীরবতার অংশ। গণযৌণ হয়রানি নিয়ে নারী বা মানবাধিকার সংগঠনগুলোর কোনো বিবৃতি বা বিক্ষোভ বা মানববন্ধনের খবর পাইনি কোনো সংবাদমাধ্যমে। যেমনটি হয়েছিল ‘সেকুলারবিদ্বেষী’ হেফাজতের সমাবেশে নারী সাংবাদিক নিপীড়িত হওয়ার পর।

এবার অন্য আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। আওয়ামী লীগের কর্মীদের দ্বারা নিপীড়ত হওয়া নারীদের মধ্যে একজন সাংবাদিকও ছিলেন, যার পোস্ট ভাইরাল হয়েছিলো সেদিন। কিন্তু এ নিয়ে সাংবাদিক সংগঠনগুলো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বা নিদেনপক্ষে ওই ঘটনার নিন্দা করে কোনো বিবৃতি দেয়নি, মানববন্ধন কর্মসূচি তো দূরের কথা। কিন্তু উপরে দেয়া স্ক্রিনশটগুলো খেয়াল করলে দেখতে পাবেন হেফাজতের সমাবেশে সাংবাদিক নিপীড়নের প্রতিবাদ করে একাধিক কর্মসূচি দিয়েছিলেন সাংবাদিক নেতারা!
আওয়ামী লীগের সমাবেশে নিপীড়িত এই নারী একজন সাংবাদিক। কিন্তু এখন প্রতিবাদে সরব নন সাংবাদিকরা

তবে হেফাজতের সমাবেশে নিপীড়নের ব্যাপারে সাংবাদিক কমিউনিটি ছিলেন সোচ্চার।

1 টি মন্তব্য: