মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৭, ২০১৮

৩ ছাত্রনেতাকে উঠিয়ে নেয়ার সংবাদ পত্রিকায় যেভাবে এসেছে


কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম তিন নেতাকে গোয়েন্দা পুলিশ কর্তৃক ক্যাম্পাস থেকে উঠিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে গতকাল সোমবার (১৬ এপ্রিল)। আজ মঙ্গলবার জাতীয় পত্রিকাগুলোতে এ নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এখানে দেখবো শীর্ষ কয়েকটি পত্রিকার মধ্যে কে কিভাবে ঘটনার খবরকে উপস্থাপন করেছে।

প্রথম আলো খবরটিকে প্রধান শিরোনাম করেছে- “চোখ বেঁধে মিন্টো রোডে, এক ঘণ্টা পর মুক্তি”। ইনসার্ট হিসেবে যুক্ত করা হয়- “শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তুলে নেয়া এক ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনকারী তিন নেতাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।” (প্রথম আলোর অনলাইনে এই রিপোর্ট না থাকায় লিংক যুক্ত করা গেল না)।

বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্য ও তথ্য মিলিয়ে প্রথম আলো ‘দায়িত্ব নিয়ে’ শিরোনাম ও ইন্ট্রো তৈরি করেছে। এখানে ‘দায়িত্ব নিয়ে’ শব্দগুলোর অর্থ হচ্ছে, শিরোনাম বা রিপোর্টের ইন্ট্রোকে কোনো একপক্ষের ‘অভিযোগ’ বা ‘দাবি’ হিসেবে তুলে ধরেনি পত্রিকাটি। ঘটনার উভয়পক্ষের ‘অভিযোগ’ ও ‘দাবি’ এবং রিপোর্টারের নিজস্ব অনুসন্ধানের আলোকে যা পাওয়া গেছে সেগুলোকে ‘তথ্য’ আকারে উপস্থাপন করেছে।

অর্থাৎ, প্রথম আলোর  রিপোর্ট অনুযায়ী, তিন ছাত্রনেতাকে ‘উঠিয়ে নেয়া’ বা গাড়িতে উঠানোর পর ‘চোখ বাঁধা’ ইত্যাদি বিষয় সত্যিকারের ‘তথ্য’, আন্দোলনকারীদের ‘অভিযোগ’ নয়।

অভিযুক্ত পুলিশ, অভিযোগকারী শিক্ষার্থী, প্রত্যক্ষদর্শী দোকানদার/শিক্ষার্থী ইত্যাদি বিভিন্ন পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরা প্রথম আলোর বেশ গোছানো রিপোর্টটি অবশ্য ডেইলি স্টারের রিপোর্টের তুলনায় কিছুটা অপূর্ণ।

সাদা পোশাকে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করার বিষয়ে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। ২০১৬ সালের মে মাসে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কাউকে সাদা পোশাকে আটক করা অবৈধ। তিন ছাত্রনেতার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা আইনের দৃষ্টিতে কতটা সঠিক ছিল- এ ব্যাপারে কোনো আইন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে মতামত নিতে পারতো প্রথম আলো।

আবার বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘গুম’ এর মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব অভিযোগ বা প্রমাণ বিভিন্ন সংস্থা নানা সময়ে উপস্থাপন করেছে, সেগুলোর সাথে গতকালের ঘটনা কতটা মিলে, এ নিয়ে মানবাধিকার কর্মীদের মতামত কী- তাও নিতে পারতো প্রথম আলো; কিন্তু নেয়া হয়নি।

তবে ডেইলি স্টার মানবাধিকার সংস্থা ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’র উদ্বেগের কথা তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে। স্টারের শিরোনাম ছিলো, “Taken blindfolded, held for an hour”। শিরোনাম ও ইন্ট্রো মিলিয়ে এই পত্রিকাটির রিপোর্টেও প্রথম আলোর মতো ঘটনার উভয়পক্ষের বক্তব্যের সাথে রিপোর্টারের নিজের সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। শিরোনাম ও ইন্ট্রোতে ‘অভিযোগ’ ‘দাবি’র কথা উল্লেখ করা থেকে বিরত থেকে স্টার। কভারেজ এর দিক থেকে স্টার এটিকে দিনের সেকন্ড লিড নিউজ হিসেবে ট্রিটমেন্ট দিয়েছে।

এছাড়া মানবজমিন খবরটিকে লিড করেছে। “গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলা হয় ওদের” শিরোনামের রিপোর্টে উভয়পক্ষের অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পাশাপাশি রিপোর্টার তার নিজের সূত্রে পাওয়া তথ্যকে কাজে লাগিয়েছেন। যদিও আইনজ্ঞ বা মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য ছিলো না।


এর বাইরে আজকের বেশিরভাগ পত্রিকায় এই ঘটনাকে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। যুগান্তরের প্রথম পাতার ভাঁজের নিচে তিন কলাম শিরোনাম করা হয়েছে, “নেতাদের চোখ বেঁধে তুলে নেয়ার অভিযোগ: পুলিশের অস্বীকার”। আন্দোলনকারীদের বাইরেও যেসব প্রত্যক্ষদর্শী আছেন তারাও তুলে নেয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। পুলিশও এটা স্বীকার করেছে যে, তিনজনকে ডিবি অফিসে নেয়া হয়েছিলো। তবে ‘উঠিয়ে নেয়ার কথা’ অস্বীকার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যুগান্তর পুলিশের ‘অস্বীকার’কে ভিকটিম ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সমান গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছে। রিপোর্টার তার নিজের অনুসন্ধানে কী পেয়েছেন তা উল্লেখ করা চেয়ে, দুইপক্ষে ‘দাবি’ আর ‘অভিযোগ’কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।


কালের কণ্ঠের প্রথম পৃষ্ঠার নিচের দিকে দুই কলামে শিরোনাম ‘তিন নেতাকে তুলে নেওয়ায় উত্তেজনা’। ভিকটিমদের বক্তব্যকে ‘অভিযোগ’ আকারে তুলে ধরেছে এই রিপোর্টেও।


বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রথম পাতায় দুই কলাম জায়গা পেয়েছে এই খবর। শিরোনাম ‘সংবাদ সম্মেলনের পর আটক কোটাবিরোধী ছাত্রনেতারা, পরে মুক্তি’। লক্ষ্যনীয় হচ্ছে, শিরোনামে ‘কোটাবিরোধী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এই শব্দটি নিয়ে আন্দোলকারীদেরকে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, তারা ‘কোটা সংস্কার’ চান, ‘বাতিল’ নয়। তারা ‘কোটাবিরোধী নন’, ‘কোটা রাখার পক্ষে, তবে সংস্কার করে।’ আন্দোলন চলাকালীন বিভিন্ন সময় ‘কোটাবিরোধী’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে শিক্ষার্থীরা মিডিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।


প্রথম পাতায় সমকালের ডাবল কলাম শিরোনাম, “তিন নেতাকে চোখ বেঁধে তুলে নেওয়ার অভিযোগ”। ডাবল কলামে ইত্তেফাক শিরোনাম করেছে “মামলা প্রত্যাহারে দুই দিনের আল্টিমেটাম”। শোল্ডার হিসেবে যোগ করেছে “তিন নেতাকে তুলে নিয়ে ছেড়ে দিল পুলিশ”। ইত্তেফাকের কাছে তিনজনকে রাস্তা থেকে জোর করে কালো গ্লাসের গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ‘আল্টিমেটামের’ চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ। আবার ‘ছেড়ে দেয়া’ নিয়ে প্রথম আলো যে তথ্য দিয়েছে (শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে ছাড়া) তারও কোনো উল্লেখ নেই ইত্তেফাকের শোল্ডারে।


সমকাল, ইত্তেফাকের রিপোর্টের ধরণও যুগান্তর-কালের কণ্ঠের মতো। ভিকটিমের বক্ত্যবকে ‘অভিযোগ’ আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে।

কভারেজের ক্ষেত্রে উপরের যে পত্রিকাগুলো খবরটির জন্য অপেক্ষাকৃত কম জায়গা বরাদ্দ রেখেছে, সেগুলোর প্রতিটিরই আজকের লিড স্টোরি ছিলো কোনো না কোনো ‘বিশেষ প্রতিবেদন’। অর্থাৎ, গতকাল দিনের ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ‘ইভেন্ট’ হিসেবে ওই তিন ছাত্রকে উঠিয়ে নেয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না সেটা পরোক্ষভাবে পত্রিকাগুলো স্বীকার করছে! ছাত্রদের ঘটনাকে প্রথম আলো বা মানবজমিনের মতো করে লিড স্টোরি করা হবে না, তাই ‘বিশেষ প্রতিবেদন’ দিয়েই সেই প্রয়োজন পূরণ করেছে এই পত্রিকাগুলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন