রবিবার, এপ্রিল ২২, ২০১৮

মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বাংলাদেশি পত্রিকায় একটি দিন



বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবছর প্রতিবেদন প্রকাশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৭ সালের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় শুক্রবার (২০ এপ্রিল, ২০১৮)। বাংলাদেশে জাতীয় পত্রিকাগুলোতে রোববার (২২ এপ্রিল) এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এদিকে শনিবার (২১ এপ্রিল) জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে ‘মায়ের ডাক’ নামে একটি সংগঠন গণশুনানির আয়োজন করে। ‘মায়ের ডাক’ হচ্ছে দেশে নিখোঁজ হওয়া এবং নিখোঁজের পরে বিভিন্ন স্থানে লাশ পাওয়া গেছে এমন ৫০ জন ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের সংগঠন।

গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের বৃদ্ধ মা হাজেরা খাতুনের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও মানবাধিকার কর্মী। তাদের মধ্যে রয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক আসিফ নজরুল, ড. মাহফুজুল্লাহ, অধিকারের সভাপতি ড. অধ্যাপক সিআর আবরার, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জুনায়েদ সাকি, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স ও অধিকার-এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানসহ প্রমুখ। গুম হওয়া ব্যক্তিদের বেশিরভাগই রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর দ্বারা নিখোঁজ হয়েছেন বলে স্বজনদের অভিযোগ। এটি মানবাধিকারের চরমতম লঙ্ঘনগুলির একটি।

আমরা এখানে দেখবো বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে এই দুইটি ঘটনাকে (মার্কিন রিপোর্ট ও গুম হওয়া স্বজনদের গণশুনানি) ঢাকার শীর্ষস্থানীয় দৈনিকগুলো কিভাবে কভারেজ দিয়েছে।


ডেইলি স্টার:

প্রথম পাতার প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে ছিলো এই দুটি ঘটনার খবর। পাঁচ কলামে ‘Hope against Hope শিরোনামের লিড স্টোরিটির ভাষা ও ছবির উপস্থাপনা ছিল খুবই হৃদয়স্পর্শী। গুম হওয়া ব্যক্তিদের শিশু ও নারী স্বজনের কান্নার দু’টি ছবিসহ প্রথম পাতায় তিনটি ছবি ছাপিয়েছে ডেইলি স্টার।

পাশে সিঙ্গেল কলামে মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট সংক্রান্ত খবরটি শিরোনাম ‘Govt took limited steps to prosecute rights abuses’। সাথে হ্যাঙ্গার হিসেবে যোগ করা হয়েছে, ‘Says US state dept report on Bangladesh’।

মার্কিন প্রতিবেদনে মানবাধিকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারি দমনপীড়ন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। স্টার চারটি উপ-শিরোনামের অধীনে-- Extra-Judicail Killing, Disappearance, Freedom of Expression, Corruption-- বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। তাতে বিরোধীদল, শ্রমিক সংগঠন, বিরোধী মতের গণমাধ্যম ইত্যাদি দমনে সরকারের চেষ্টার কথাও তুলে ধরা হয়েছে।


নিউ এইজ:

নিউজের প্রথম পাতায় সেকন্ড লিড স্টোরি হিসেবে গুম নিয়ে গণশুনানির খবরটি ছাপা হয়েছে ৫ কলামে। শিরোনাম “Families, victims narrate ordeals"। সাথে চার কলামজুড়ে স্টেজে দাঁড়িয়ে এক নারীর কান্নার ছবি। পাশে সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়েছে মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে প্রতিবেদন- “Bangladesh did little to prosecute abuses, killings by security forces: US" (ইউএনবির সূত্রে)।


প্রথম আলো:

‘কষ্টের গল্প আর বিচারের দাবি’ শিরোনামে প্রথম পাতার ভাঁজের নিচে চার কলামে (একটি ছবিসহ) ‘গুম নিয়ে গণশুনানি’র খবর ছাপিয়েছে প্রথম আলো। এই খবরের জাম্প ২য় পাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পাশেই তিন কলামে শিরোনাম করা হয়েছে মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টের খবর- “বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মত প্রকাশে বিধিনিষেধ বড় সমস্যা”। ‘গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা’ এবং ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক দুটি উপশিরোনামে আলাদা করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। মার্কিন রিপোর্টের বিষয়ে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হকের মন্তব্য যুক্ত করেছে পত্রিকাটি।


কালের কণ্ঠ:

মানবাধিকার রিপোর্ট নিয়ে প্রথম পাতায় ডাবল কলামে কালের কণ্ঠের শিরোনাম “নিরাপত্তা বাহিনীর হত্যা নির্যাতন বন্ধে উদ্যোগ সামান্য”। নিচে হ্যাঙ্গার যোগ করা হয়েছে “বাকস্বাধীনতাও ছিল সীমাবদ্ধ”। গুম নিয়ে গণশুনানির খবরটি ছাপা হয়েছে ১৯তম পৃষ্ঠায়। শিরোনাম “পাঁচ বছরে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা-নির্যাতনের শিকার ৭২৭ জন”। তিন কলামের প্রতিবেদনটির সাথে ছিল একটি তিন কলাম ছবিও।


যুগান্তর:

প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে যুগান্তরের শিরোনাম “বাংলাদেশে সভা সমাবেশ সীমিত করেছে সরকার: মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭”। আর শেষের পাতায় সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়েছে গুম নিয়ে গণশুনানির খবর- “লাশ হলেও ফেরত চান গুমদের স্বজনরা”। সাথে তিন কলাম একটি ছবি ছাপানো হয়েছে।



সমকাল: 

প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো “জামায়াত এখন এনজিও”। সমকালের রিপোর্টে ইন্ট্রোর পরে একটি লাইন চোখে পড়ার মতো--

“...এতে মোটা দাগে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, বিচার বিভাগ ও রাজনৈতিক অধিকারের স্বাধীনতায় উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতার দাবি করা হলেও বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমারকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। তবে নিজ দেশের মিডিয়াকে 'জনগণের শত্রু ও ভুয়া' দাবি করা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের অন্য দেশের গণমাধ্যম নিয়ে দাদাগিরি করার যৌক্তিকতা কতটুকু- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।”

শেষের লাইনটিতে শ্লেষাত্মকভাবে যে প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে সেটি কার প্রশ্ন তা পুরো রিপোর্টে কোথাও বলা হয়নি। অর্থাৎ, রিপোর্টার কারো কোনো উদ্ধৃতি ছাড়াই নিজের মন মতো প্রশ্নটি জুড়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত বক্তব্যগুলোকে শিরোনাম বা ইন্ট্রোতে উল্লেখ না করে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

এদিকে গুম নিয়ে গণশুনানির খবর ২য় পাতায় সিঙ্গেল কলামে ছাপিয়েছে সমকাল। ‘নিখোঁজদের পরিবার নিয়ে গনশুনানি: আর কত কাঁদব আমরা’ শিরোনামের প্রতিবেদনে সাথে একটি ছবি ছাপানো হয়েছে। রিপোর্টের ভাষায় বেশ মানবিক আবেদন ফুটে ওঠলেও ডেইলি স্টারের তুলনায় কভারেজ খুবই নগণ্য ছিলো।

বাংলাদেশ প্রতিদিন:

প্রথম পাতায় বাংলাদেশ প্রতিদিন এর শিরোনাম “জামায়াত কি এখন এনজিও”। হ্যাঙ্গার হিসেবে আছে “স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন # বিস্ময় সব মহলে”। মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক তথ্যগুলো নিয়ে যাওয়া হয়েছে ইন্ট্রোর পরে। অন্যদিকে গুম নিয়ে শুনানির খবরটি ছাপা হয়েছে নামকাওয়াস্তে; ১১তম পৃষ্ঠায়। ‘নিখোঁজদের সন্ধান দাবি স্বজনদের’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে মোট শব্দ খরচ করা হয়েছে ৫৬টি! সাথে কোনো ছবিও ছিলো না।


ইত্তেফাক: 

“ওদের ফিরিয়ে দিন” শিরোনামে শেষের পাতার একদম ডান দিকের কোণায় ডাবল কলামে গুম নিয়ে গণশুনানির খবরটি ছাপিয়েছে ইত্তেফাক। ফিচারধর্মী রিপোর্টের বর্ণনা মানবিক হলেও সাথে ছিলো না কোনো ছবি।

মার্কিন মানবাধিকার রিপোর্টের খবরটি প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে ছাপা হয়েছে “রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞে জড়িতদের দায়মুক্তি দিচ্ছে মিয়ানমার” শিরোনামে। ইত্তেফকের এই প্রতিবেদনের প্রথম চার প্যারায় মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত গুম-খুনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে গুম-খুনসহ সার্বিক মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রসঙ্গ নিয়ে যাওয়া হয়েছে এর পরে।

সংবাদের ট্রিটমেন্ট ও রিপোর্টের ভাষার দিক থেকে মানবাধিকার সংক্রান্ত উপরিউক্ত দু'টি ঘটনার খবরকে সবচেয়ে বেশি যত্ন ও গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছে ডেইলি স্টার ও নিউ এইজ পত্রিকা। প্রথম আলোর ভাষা ও উপস্থাপনায় বিশেষ যত্ন পরিলক্ষিত হলেও স্টার ও নিউ এইজের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সংবাদগুলো ছাপা হয়েছে। অন্য পত্রিকাগুলোর রিপোর্টের ভাষা ও কভারেজে উদাসীনতার ছাপ স্পষ্ট। দুয়েকটি পত্রিকা তো বাংলাদেশে সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ উপেক্ষা করে ভিন্ন বিষয়কে হাইলাইট করার চেষ্টা করেছে।

মানবাধিকারের ভিত্তির ওপর স্বাধীন গণমাধ্যম দাঁড়িয়ে থাকে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মানবাধিকারের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে-- “Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers.”

ফলে নিজের স্বার্থেই গণমাধ্যমকে মানবাধিকার অক্ষুন্ন রাখার পক্ষে সরব থাকতে হয়। এছাড়া গণমাধ্যমের গণতান্ত্রিক দায়িত্বাবলীর মধ্যে অন্যতম হলো মানবাধিকার অক্ষুন্ন রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। অথচ রোববারের বেশিরভাগ বাংলাদেশি পত্রিকায় মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত দুটি খবরকে গৌণ করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে- তা উপরের আলোচনায় স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন