কদরুদ্দীন শিশির
৩০ সেপ্টেম্বর রাতটি ছিল শুক্রবার দিবাগত রাত। এই রাতের শেষের দিকে বাংলাদেশের দুই স্থানে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর একটি লক্ষ্মীপুর জেলায়, অন্যটি ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারে। উভয়টিই ছিল বহুল আলোচিত-সমালোচিত কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার ঘটনা। উভয় ঘটনাই ঘটে পুলিশের হাতে। সাভারে নিহত ব্যক্তির নাম শাহ আলম নয়ন (৪৪)। তিনি স্থানীয় পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। পুলিশ তাকে ‘মাদক ব্যবসায়ী এবং ১৪ মামলার আসামি’ বলে জানিয়েছে। আর লক্ষ্মীপুরে নিহতের নাম মো. নিজাম (২৮)। তাকে পুলিশ ‘জলদস্য এবং মামলার আসামি’ বলেছে। দু’জনই পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্থায় নিহত হয়েছেন।
যেহেতু নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে থাকাবস্থায় নিহত হওয়ার ঘটনা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’, ফলে এর স্পর্শকাতরতা অন্যান্য সাধারণ হত্যার চেয়ে অনেক বেশি। এজন্য এ ধরনের ঘটনার সংবাদ কভারেজের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে আলাদাভাবে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযোগকেই ‘সর্ব সত্য’ বিবেচনা করে তুলে ধরার মাধ্যমে ভিকটিমের বিরুদ্ধে একটি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ না হয়ে যায়। সাধারণ যে কোনো ঘটনায়ও অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী উভয়ের বক্তব্য ভারসাম্যপূর্ণভাবে তুলে ধরা সাংবাদিকতার নৈতিকতা। আর সরকারি বাহিনীর মতো শক্তিমান পক্ষের অভিযোগের বিপরীতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভিকটিম পক্ষের বক্তব্য বা অভিযোগ সমান গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা সাংবাদিকের জন্য বাধ্যতামূলক। এর ব্যতিক্রম সংবাদমাধ্যমকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
এখন যাচাই করে দেখা যেতে পারে উপরিউক্ত দুটি হত্যার সংবাদ কভারেজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম (অনলাইন/ পত্রিকা-টিভির ওয়েবসাইট) কতটা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।
প্রথমে লক্ষ্মীপুরের ঘটনাটি দেখা যাক। এনটিভি অনলাইন (এনটিভিবিডি) শিরোনাম করেছে “লক্ষ্মীপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যুবক নিহত”। ইন্ট্রোতে লেখা হয়েছে, “লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মো. নিজাম (২৮) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন।”
শিরোনাম ও ইন্ট্রোতে ‘যুবক’ উল্লেখ করলেও ভেতরে পুরো রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে পুলিশের বক্তব্য দিয়ে। পুলিশ তাকে ‘জলদস্যু’ এবং ‘চারটি মামলার আসামি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নিহতের স্বজনদের কোনো বক্তব্য নেই।
এনটিভি অনলাইন তাদের শিরোনামে পুলিশের ব্যবহৃত অভিযোগ সংক্রান্ত শব্দগুলো (‘জলদস্য’ বা ‘মামলার আসামি’) হুবহু কপি করে না দিলেও বাকি সংবাদমাধ্যমগুলো সেইসব শব্দ হুবহু কপি করে শিরোনামে দিয়েছে।
যেমন- বিডিনিউজ শিরোনাম করেছে “লক্ষ্মীপুরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ‘আসামি’ নিহত”। এনটিভির মতো ‘যুবক’ বা অন্যভাবে দিলে ‘একজন নিহত’ কিংবা ‘নিহত ১’ ইত্যাদি কিছু না দিয়ে পুলিশের অনুকূলে ‘আসামি’ শব্দটিই ব্যবহার করেছে। অবশ্য শব্দটির দু’পাশে উদ্ধরণ কমা ব্যবহার করে কিছুটা ‘দায়’ এড়িয়েছে বিডিনিউজ।
পুলিশের এএসপির বক্তব্য দিয়ে পুরো রিপোর্ট তৈরি। নিহতের স্বজন বা কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সংঘটিত হওয়ার স্থানের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা ‘প্রত্যক্ষশ্রোতা’র (গুলির আওয়াজ শোনা যাওয়ার কথা) বক্তব্য নেই। এমনকি হাসপাতালের মর্গে রাখার তথ্য দেয়া হলেও সেই হাসপাতালের ডাক্তারদের, বিশেষ করে যিনি তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন বা সুরতহাল করেছেন তার, কোনো বক্তব্য দেয়নি বিডিনিউজ।
ভেতরে একচেটিয়া পুলিশি ‘ধারাভাষ্য’ প্রকাশ করলেও বিডিনিউজ অন্তত শিরোনামে পুলিশের ব্যবহার করা ‘আসামি’ শব্দটিকে উদ্ধরণ কমার মধ্যে ঢুকিয়েছে, আবার ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এর আগে ‘কথিত’ শব্দটি লাগিয়েছে।
কিন্তু বাংলানিউজের শিরোনাম একদম সরাসরি- “রামগতিতে বন্দুকযুদ্ধে দস্যু নিহত”।
‘দস্যু’কে তো নয়-ই, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শব্দটিকেও দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশ করছে সংবাদমাধ্যমটি!
সরকারি বাহিনীগুলোর এসব ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে দেশি-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সন্দেহ ও আপত্তি থাকায় এখন পর্যন্ত এখানকার সবপন্থী সংবাদমাধ্যমই আমভাবে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’ জাতীয় শব্দগুলো নিজ দায়িত্বে প্রকাশ করে না। বরং সেগুলোর আগে ‘কথিত’ শব্দ বা আগে-পরে উদ্ধরণ কমা ব্যবহার করে প্রকাশ করে। এতে এটাই বুঝানো হয় যে, এইসব শব্দ যে অর্থ দিচ্ছে তার সত্য-মিথ্যার দায় বক্তার (সরকারি বাহিনীর), সংবাদমাধ্যমের নয়। তবে বাংলানিউজ লক্ষ্মীপুরের এই যুবক নিহতের ঘটনায় যে উভয়পক্ষে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে এবং যুবকটি যে ‘দস্যু’ ছিল- তা পুলিশের মতো ‘নিশ্চিত’ করে দিচ্ছে!
ফলে, বাংলানিউজের রিপোর্টে পুলিশের একচেটিয়া ভাষ্যের বাইরে ভিকটিমের স্বজন বা এরকম কারো ভাষ্য পাওয়ার প্রশ্নই আসে না! নাইও।
প্রথম আলো তাদের অনলাইনের শিরোনামে ‘নিহত ১’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। “রামগতিতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ১”।
ইন্ট্রোতে নিহতের ব্যাপারে লিখেছে ‘এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন’। আর ‘জলদস্যু’ পরিচয়টির বিষয়ে বলা হয়েছে “পুলিশের দাবি, নিজাম জলদস্যু।” রিপোর্টের ভেতরে অবশ্য পুলিশের একচেটিয়া ভাষ্য। নিহত ব্যক্তি কোথায় বসবাস করতেন সেই তথ্য দিয়েছে প্রথম আলো, তবে সেখানকার তার কোনো স্বজনের বক্তব্য নেই। এবং এমন কোনো কথাও নেই যে, “স্বজনদের বা ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।”
সদ্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অনলাইন পোর্টাল বাংলাট্রিবিউনের শিরোনাম “লক্ষ্মীপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জলদস্যু নিহত”।
আগের মতোই এখানেও রিপোর্ট পুরোপুরি পুলিশি বক্তব্য দিয়ে তৈরি। নিহতের বাবার পরিচয় পর্যন্ত দেয়া হলেও তার বা অন্য কোনো স্বজন বা এলাকাবাসীর বক্তব্য (যেমন নাজিম আদৌ কেমন ছেলে ছিল?) দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি বাংলাট্রিবিউনও।
নয়া দিগন্ত অনলাইনের শিরোনাম- “রামগতিতে 'বন্দুকযুদ্ধে' জলদস্যু নিহত”। নয়াদিগন্ত ধরে নিয়েছে, পুলিশ যেহেতু বলেছে নিহত ব্যক্তি জলদস্যু তাহলে অবশ্যই জলদস্যু না হয়ে পারে না। এজন্য পত্রিকাটি উদ্ধরণ কমা ছাড়াই শব্দটিকে শিরোনামে দিয়েছে। আবার স্বজনের কোনো বক্তব্যও দেয়নি।
সাভারে যুবদল নেতা হত্যার ঘটনা :
এ ঘটনায় বাংলাট্রিবিউনের রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে- “যুবদল নেতাকে গ্রেফতার করে টাকা আদায়, এরপর ক্রসফায়ার!”
ইন্ট্রোতে বলা হয়েছে,
নিহতের মায়ের অভিযোগ তুলে ধরে ট্রিবিউন লিখেছে,
বাকি যারা এই ঘটনার রিপোর্ট করেছে তারা পুলিশের দেয়া বক্তব্যের সাথে ‘ঐকমত্য’ পোষণ করেই তৈরি করেছে।
বাংলানিউজের রিপোর্টের শিরোনাম “সাভারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নিহত”। রিপোর্টের ভেতরে পুরোটাই পুলিশের বক্তব্য, নিহতের স্বজনের কোনো ভাষ্য নেই।
বরং নিহতের বিরুদ্ধে পুলিশের বাড়তি অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্যগুলো রিপোর্টের প্রথম দিকেই এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে--
এনটিভি অনলাইন আগের লক্ষ্মীপুরের ঘটনায় পুলিশের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন বক্তব্য শিরোনামে হাজির করলেও, এ ক্ষেত্রে পুরো রিপোর্ট পুলিশের প্রেসিবিজ্ঞপ্তির মতো তুলে দেয়া হয়েছে। শিরোনাম ‘সাভারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যুবদল নেতা নিহত’
ভিকটিমের স্বজন-ডাক্তার কারো কোনো বক্তব্য নেই রিপোর্টে।
বিডিনিউজের শিরোনাম “সাভারে কথিত বন্দুকযুদ্ধে যুবদল নেতা নিহত”। অনলাইন পত্রিকাটি এই রিপোর্টে নিহতের ছোট ভাই মাসুদ আলম লিটনের বক্তব্য দুই প্যারায় প্রকাশ করেছে। তবে তার আগে ওসির বক্তব্য মতে নিহতের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোকে হাইলাইট করেছে এভাবে--
একই কায়দা করেছে জাগোনিউজ নামে আরেকটি অনলাইন। তাদের রিপোর্টে নিহতের স্বজন লিটনের বক্তব্য সম্বলিত একটি বাক্য থাকলেও পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা নেয়ার অভিযোগ সংক্রান্ত কিছু নেই।
কালের কণ্ঠের অনলাইনেও একই ধাঁচে এসেছে রিপোর্ট।
দৈনিক ইত্তেফাকের কাছে সংবাদটি খুবই গুরুত্বহীন! পত্রিকাটি নিজের অনলাইনে সংবাদটির জন্য মাত্র তিনটি বাক্য ব্যয় করেই ক্ষান্ত দিয়েছে। শিরোনাম ‘সাভারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যুবদল নেতা নিহত’।
মজার বিষয় হচ্ছে, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কারো মারা যাওয়া যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড- এই কথাটি উপরের দুই ঘটনায় উল্লিখিত এতগুলো রিপোর্টের একটিতেও একবারের জন্যও বলা হয়নি! ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ টার্মটি সংবাদমাধ্যম থেকে গায়েব হয়ে গেছে!
যাইহোক, দুটি ঘটনার রিপোর্ট বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেভাবে এসেছে তার উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, বিচাবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের বিষয়ে বাংলাদেশের পুলিশ (বা যে কোনো নিরাপত্তা সংস্থা) এবং সাংবাদিকদের মধ্যে একটা মানসিক ঐক্য বিরাজ করছে। পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, অথচ মিডিয়া সেটাকে সার্বিক অর্থে নেতিবাচক হিসেবে তুলে না ধরে বরং পুলিশের পক্ষে পাঠককে প্রভাবিত করছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য এটি নিঃসন্দেহে খুবই বিদপজ্জনক অবস্থা।
৩০ সেপ্টেম্বর রাতটি ছিল শুক্রবার দিবাগত রাত। এই রাতের শেষের দিকে বাংলাদেশের দুই স্থানে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর একটি লক্ষ্মীপুর জেলায়, অন্যটি ঢাকার উপকণ্ঠ সাভারে। উভয়টিই ছিল বহুল আলোচিত-সমালোচিত কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার ঘটনা। উভয় ঘটনাই ঘটে পুলিশের হাতে। সাভারে নিহত ব্যক্তির নাম শাহ আলম নয়ন (৪৪)। তিনি স্থানীয় পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক। পুলিশ তাকে ‘মাদক ব্যবসায়ী এবং ১৪ মামলার আসামি’ বলে জানিয়েছে। আর লক্ষ্মীপুরে নিহতের নাম মো. নিজাম (২৮)। তাকে পুলিশ ‘জলদস্য এবং মামলার আসামি’ বলেছে। দু’জনই পুলিশি হেফাজতে থাকাবস্থায় নিহত হয়েছেন।
যেহেতু নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে থাকাবস্থায় নিহত হওয়ার ঘটনা ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’, ফলে এর স্পর্শকাতরতা অন্যান্য সাধারণ হত্যার চেয়ে অনেক বেশি। এজন্য এ ধরনের ঘটনার সংবাদ কভারেজের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমকে আলাদাভাবে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, যাতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযোগকেই ‘সর্ব সত্য’ বিবেচনা করে তুলে ধরার মাধ্যমে ভিকটিমের বিরুদ্ধে একটি ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ না হয়ে যায়। সাধারণ যে কোনো ঘটনায়ও অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী উভয়ের বক্তব্য ভারসাম্যপূর্ণভাবে তুলে ধরা সাংবাদিকতার নৈতিকতা। আর সরকারি বাহিনীর মতো শক্তিমান পক্ষের অভিযোগের বিপরীতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভিকটিম পক্ষের বক্তব্য বা অভিযোগ সমান গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা সাংবাদিকের জন্য বাধ্যতামূলক। এর ব্যতিক্রম সংবাদমাধ্যমকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
এখন যাচাই করে দেখা যেতে পারে উপরিউক্ত দুটি হত্যার সংবাদ কভারেজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম (অনলাইন/ পত্রিকা-টিভির ওয়েবসাইট) কতটা তাদের দায়িত্ব পালন করেছে।
প্রথমে লক্ষ্মীপুরের ঘটনাটি দেখা যাক। এনটিভি অনলাইন (এনটিভিবিডি) শিরোনাম করেছে “লক্ষ্মীপুরে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যুবক নিহত”। ইন্ট্রোতে লেখা হয়েছে, “লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মো. নিজাম (২৮) নামের এক যুবক নিহত হয়েছেন।”
শিরোনাম ও ইন্ট্রোতে ‘যুবক’ উল্লেখ করলেও ভেতরে পুরো রিপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে পুলিশের বক্তব্য দিয়ে। পুলিশ তাকে ‘জলদস্যু’ এবং ‘চারটি মামলার আসামি’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। নিহতের স্বজনদের কোনো বক্তব্য নেই।
এনটিভি অনলাইন তাদের শিরোনামে পুলিশের ব্যবহৃত অভিযোগ সংক্রান্ত শব্দগুলো (‘জলদস্য’ বা ‘মামলার আসামি’) হুবহু কপি করে না দিলেও বাকি সংবাদমাধ্যমগুলো সেইসব শব্দ হুবহু কপি করে শিরোনামে দিয়েছে।
যেমন- বিডিনিউজ শিরোনাম করেছে “লক্ষ্মীপুরে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ‘আসামি’ নিহত”। এনটিভির মতো ‘যুবক’ বা অন্যভাবে দিলে ‘একজন নিহত’ কিংবা ‘নিহত ১’ ইত্যাদি কিছু না দিয়ে পুলিশের অনুকূলে ‘আসামি’ শব্দটিই ব্যবহার করেছে। অবশ্য শব্দটির দু’পাশে উদ্ধরণ কমা ব্যবহার করে কিছুটা ‘দায়’ এড়িয়েছে বিডিনিউজ।
পুলিশের এএসপির বক্তব্য দিয়ে পুরো রিপোর্ট তৈরি। নিহতের স্বজন বা কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সংঘটিত হওয়ার স্থানের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বা ‘প্রত্যক্ষশ্রোতা’র (গুলির আওয়াজ শোনা যাওয়ার কথা) বক্তব্য নেই। এমনকি হাসপাতালের মর্গে রাখার তথ্য দেয়া হলেও সেই হাসপাতালের ডাক্তারদের, বিশেষ করে যিনি তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন বা সুরতহাল করেছেন তার, কোনো বক্তব্য দেয়নি বিডিনিউজ।
ভেতরে একচেটিয়া পুলিশি ‘ধারাভাষ্য’ প্রকাশ করলেও বিডিনিউজ অন্তত শিরোনামে পুলিশের ব্যবহার করা ‘আসামি’ শব্দটিকে উদ্ধরণ কমার মধ্যে ঢুকিয়েছে, আবার ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এর আগে ‘কথিত’ শব্দটি লাগিয়েছে।
কিন্তু বাংলানিউজের শিরোনাম একদম সরাসরি- “রামগতিতে বন্দুকযুদ্ধে দস্যু নিহত”।
‘দস্যু’কে তো নয়-ই, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ শব্দটিকেও দায়িত্ব নিয়ে প্রকাশ করছে সংবাদমাধ্যমটি!
সরকারি বাহিনীগুলোর এসব ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে দেশি-বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সন্দেহ ও আপত্তি থাকায় এখন পর্যন্ত এখানকার সবপন্থী সংবাদমাধ্যমই আমভাবে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’ জাতীয় শব্দগুলো নিজ দায়িত্বে প্রকাশ করে না। বরং সেগুলোর আগে ‘কথিত’ শব্দ বা আগে-পরে উদ্ধরণ কমা ব্যবহার করে প্রকাশ করে। এতে এটাই বুঝানো হয় যে, এইসব শব্দ যে অর্থ দিচ্ছে তার সত্য-মিথ্যার দায় বক্তার (সরকারি বাহিনীর), সংবাদমাধ্যমের নয়। তবে বাংলানিউজ লক্ষ্মীপুরের এই যুবক নিহতের ঘটনায় যে উভয়পক্ষে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়েছে এবং যুবকটি যে ‘দস্যু’ ছিল- তা পুলিশের মতো ‘নিশ্চিত’ করে দিচ্ছে!
ফলে, বাংলানিউজের রিপোর্টে পুলিশের একচেটিয়া ভাষ্যের বাইরে ভিকটিমের স্বজন বা এরকম কারো ভাষ্য পাওয়ার প্রশ্নই আসে না! নাইও।
প্রথম আলো তাদের অনলাইনের শিরোনামে ‘নিহত ১’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। “রামগতিতে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ১”।
ইন্ট্রোতে নিহতের ব্যাপারে লিখেছে ‘এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন’। আর ‘জলদস্যু’ পরিচয়টির বিষয়ে বলা হয়েছে “পুলিশের দাবি, নিজাম জলদস্যু।” রিপোর্টের ভেতরে অবশ্য পুলিশের একচেটিয়া ভাষ্য। নিহত ব্যক্তি কোথায় বসবাস করতেন সেই তথ্য দিয়েছে প্রথম আলো, তবে সেখানকার তার কোনো স্বজনের বক্তব্য নেই। এবং এমন কোনো কথাও নেই যে, “স্বজনদের বা ডাক্তারের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।”
সদ্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা অনলাইন পোর্টাল বাংলাট্রিবিউনের শিরোনাম “লক্ষ্মীপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জলদস্যু নিহত”।
আগের মতোই এখানেও রিপোর্ট পুরোপুরি পুলিশি বক্তব্য দিয়ে তৈরি। নিহতের বাবার পরিচয় পর্যন্ত দেয়া হলেও তার বা অন্য কোনো স্বজন বা এলাকাবাসীর বক্তব্য (যেমন নাজিম আদৌ কেমন ছেলে ছিল?) দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেনি বাংলাট্রিবিউনও।
নয়া দিগন্ত অনলাইনের শিরোনাম- “রামগতিতে 'বন্দুকযুদ্ধে' জলদস্যু নিহত”। নয়াদিগন্ত ধরে নিয়েছে, পুলিশ যেহেতু বলেছে নিহত ব্যক্তি জলদস্যু তাহলে অবশ্যই জলদস্যু না হয়ে পারে না। এজন্য পত্রিকাটি উদ্ধরণ কমা ছাড়াই শব্দটিকে শিরোনামে দিয়েছে। আবার স্বজনের কোনো বক্তব্যও দেয়নি।
সাভারে যুবদল নেতা হত্যার ঘটনা :
এ ঘটনায় বাংলাট্রিবিউনের রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে- “যুবদল নেতাকে গ্রেফতার করে টাকা আদায়, এরপর ক্রসফায়ার!”
ইন্ট্রোতে বলা হয়েছে,
“যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ‘শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’ শাহ আলম নিয়নকে (৩৫) মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে ‘ছেড়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আদায়ের’ পর, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ এ নেতার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।”
নিহতের মায়ের অভিযোগ তুলে ধরে ট্রিবিউন লিখেছে,
“নিহত যুবদল নেতার মা রোকেয়া বেগম অভিযোগ করে বলেন, সাভার মডেল থানার উপপরিদর্শক (এস আই) তন্ময় ও এ এস আই আহসান শুক্রবার রাজধানীর মোহাম্মপুরে তাদের নিজ বাড়ি থেকে অভিযান চালিয়ে তার ছেলেকে গ্রেফতার করে। এসময় তাদের কাছ থেকে নগদ ছয় লাখ টাকা ও কয়েক ভরি স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে আসে পুলিশের কর্মকর্তারা।এই ‘বন্দুকযুদ্ধে’র ঘটনায় বাংলাট্রিবিউনের এটাই মূল এবং একমাত্র রিপোর্ট। এটি এ সংক্রান্ত আগের কোনো রিপোর্টের ফলোআপ নয়। এই বিষয়টি এজন্য লক্ষণীয় যে, পুলিশ বর্ণিত কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় এভাবে ভিকটিমের অভিযোগকে প্রাধান্য দিয়ে শিরোনাম ও ইন্ট্রো করা যায় (একই রিপোর্টের প্রথম শিরোনামটি অবশ্য গৎবাঁধাই ছিল। পরে সম্ভবত ভিকটিমের বক্তব্য পেয়ে এডিট করে নতুন শিরোনাম দেয়া হয়েছে।) । যদিও বাংলাদেশে এই চর্চা এখন নাই বললেও চলে। দেখা যায়, সবক্ষেত্রেই পুলিশের বক্তব্যকে ‘মূল ভিত্তি’ ধরে বন্দুকযুদ্ধের রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
এছাড়াও বিএনপি ওই নেতাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য সাভারের হেমায়েতপুর এলাকায় তাদের বাসা থেকেও পুলিশের ওই দুই কর্মকর্তারা নগদ আড়াই লাখ টাকা নিয়ে আসে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়াও আটককৃত বিএনপি নেতার মা আরও অভিযোগ করে বলেন, শুক্রবার রাতে সাভার মডেল থানায় তিনি তার ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে পুলিশ নয়নের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি।
নিহতের মা জানান, এর কিছু সময় পরই নয়নের মুখে কালো কাপড় দিয়ে বেঁধে তাকে নিয়ে থানা থেকে বের হয়ে যায় পুলিশ।”
বাকি যারা এই ঘটনার রিপোর্ট করেছে তারা পুলিশের দেয়া বক্তব্যের সাথে ‘ঐকমত্য’ পোষণ করেই তৈরি করেছে।
বাংলানিউজের রিপোর্টের শিরোনাম “সাভারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নিহত”। রিপোর্টের ভেতরে পুরোটাই পুলিশের বক্তব্য, নিহতের স্বজনের কোনো ভাষ্য নেই।
বরং নিহতের বিরুদ্ধে পুলিশের বাড়তি অভিযোগ সংক্রান্ত তথ্যগুলো রিপোর্টের প্রথম দিকেই এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে--
“যুবদলের এ নেতার বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ হত্যাসহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।”কোনো হত্যার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে মূল তথ্যগুলোর চেয়ে নিহত ব্যক্তির বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগকে বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া দৃষ্টিকটু। এমন আচরণকে কেউ যদি হত্যাকাণ্ড ‘জাস্টিফাই’ করার মনোভাব বলে দাবি করলে তাহলে সেটা উড়িয়ে দেয়া যাবে না।
এনটিভি অনলাইন আগের লক্ষ্মীপুরের ঘটনায় পুলিশের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন বক্তব্য শিরোনামে হাজির করলেও, এ ক্ষেত্রে পুরো রিপোর্ট পুলিশের প্রেসিবিজ্ঞপ্তির মতো তুলে দেয়া হয়েছে। শিরোনাম ‘সাভারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যুবদল নেতা নিহত’
ভিকটিমের স্বজন-ডাক্তার কারো কোনো বক্তব্য নেই রিপোর্টে।
বিডিনিউজের শিরোনাম “সাভারে কথিত বন্দুকযুদ্ধে যুবদল নেতা নিহত”। অনলাইন পত্রিকাটি এই রিপোর্টে নিহতের ছোট ভাই মাসুদ আলম লিটনের বক্তব্য দুই প্যারায় প্রকাশ করেছে। তবে তার আগে ওসির বক্তব্য মতে নিহতের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোকে হাইলাইট করেছে এভাবে--
“সাভার পৌর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক নয়নের বিরুদ্ধে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে মানুষ হত্যা, পুলিশের ওপর হামলা, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক চোরাচালন এবং অপহরণ-হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা রয়েছে বলে জানান ওসি।”অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে মায়ের করা যেসব অভিযোগ বাংলাট্রিবিউন প্রকাশ করেছে গুরুত্ব দিয়ে, সেসব কোনো অভিযোগকে রিপোর্টে আনেনি বিডিনিউজ।
একই কায়দা করেছে জাগোনিউজ নামে আরেকটি অনলাইন। তাদের রিপোর্টে নিহতের স্বজন লিটনের বক্তব্য সম্বলিত একটি বাক্য থাকলেও পুলিশের বিরুদ্ধে টাকা নেয়ার অভিযোগ সংক্রান্ত কিছু নেই।
কালের কণ্ঠের অনলাইনেও একই ধাঁচে এসেছে রিপোর্ট।
দৈনিক ইত্তেফাকের কাছে সংবাদটি খুবই গুরুত্বহীন! পত্রিকাটি নিজের অনলাইনে সংবাদটির জন্য মাত্র তিনটি বাক্য ব্যয় করেই ক্ষান্ত দিয়েছে। শিরোনাম ‘সাভারে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ যুবদল নেতা নিহত’।
ইত্তেফাকের তিন লাইনের প্রতিবেদন |
যাইহোক, দুটি ঘটনার রিপোর্ট বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে যেভাবে এসেছে তার উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে এটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, বিচাবহির্ভূত হত্যকাণ্ডের বিষয়ে বাংলাদেশের পুলিশ (বা যে কোনো নিরাপত্তা সংস্থা) এবং সাংবাদিকদের মধ্যে একটা মানসিক ঐক্য বিরাজ করছে। পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে, অথচ মিডিয়া সেটাকে সার্বিক অর্থে নেতিবাচক হিসেবে তুলে না ধরে বরং পুলিশের পক্ষে পাঠককে প্রভাবিত করছে। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির জন্য এটি নিঃসন্দেহে খুবই বিদপজ্জনক অবস্থা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন