বুধবার, অক্টোবর ২৬, ২০১৬

অবিচারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে মিডিয়ার প্রত্যক্ষ ভূমিকা


কদরুদ্দীন শিশির

প্রথমে কয়েক সংবাদের শিরোনাম এবং স্ক্রীনশট দেখে নিই।

২১ অক্টোবর দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনের একটি সংবাদের শিরোনাম- “তাবেলা হত্যায় নব্য জেএমবি জড়িত: র‍্যাব”

প্রথম আলোর ওয়েবসাইট থেকে নেয়া এই সংবাদের স্ক্রীনশট-


পরদিন ২২ অক্টোবর প্রথম আলোর প্রিন্ট ভার্সনের এ সংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম- “সারোয়ারের নেতৃত্বে হলি আর্টিজানসহ ২২ হামলা”

এই সংবাদের স্ক্রীনশট-

২২ অক্টোবর ডেইলি স্টার পত্রিকার প্রথম পাতার সংবাদ শিরোনাম- “Tavella shot dead 'by Neo JMB”

স্টারের ই-ভার্সন থেকে নেয়া স্ক্রীনশট-

দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের ২২ অক্টোবরের প্রথম পাতার সংবাদ শিরোনাম- ‌“নব্য জেএমবির পরিকল্পনায় তাভেলা সিজার খুন : র‌্যাব”

পত্রিকাটির ই-ভার্সন থেকে নেয়া এই সংবাদের স্ক্রীনশট-

দৈনিক মানবজমিনের অনলাইন ভার্সনে ২১ অক্টোবরের শিরোনাম “তাবেলা সিজার হত্যায় নব্য জেএমবি জড়িত: র‌্যাব ডিজি”

মানবজমিনের স্ক্রীনশট-

এই শিরোনামগুলো একদম প্রত্যক্ষ বক্তব্য-নির্ভর হওয়ার কারণে এগুলোকে সিলেক্ট করে তুলে ধরলাম। ২১ এবং ২২ অক্টোবরের অন্যান্য সব পত্রিকায়ও এই সংবাদটি এবং র‌্যাবের বক্তব্য বিস্তারিত এসেছে। তবে বেশিরভাগের শিরোনাম সরাসরি এভাবে ছিল না। যদিও ভেতরে র‌্যাবের বক্তব্য ছিল।

র‌্যাবের বক্তব্যটা কী তা উপরের শিরোনামগুলোতে স্পষ্ট? তবু একটি পত্রিকা থেকেই আরেকটু বিস্তারিত উল্লেখ করা যাক।

ডেইলি স্টার লিখেছে--
Documents recovered from several “Neo JMB” dens claim that Italian aid worker Cesare Tavella was shot dead by the militant group, Rapid Action Battalion said yesterday. 
The special force distributed a press release among journalists during a press briefing at its new media centre in the capital's Karwan Bazar yesterday. The release had a list of 19 attacks claimed by the “Neo JMB” and the killing of the foreigner in Gulshan diplomatic zone on September 28 last year was mentioned at the top.
The attacks were carried out by militants under the leadership of Shaykh Abu Ibrahim Al Hanif alias Sarwar Jahan alias Abdur Rahman, it said, quoting the documents.
প্রথম আলোর অনলাইনে “তাবেলা হত্যায় নব্য জেএমবি জড়িত: র‍্যাব” রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে--
রাজধানীর গুলশানে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলা হত্যাসহ ১৮টি নাশকতার ঘটনায় নব্য জেএমবি জড়িত বলে দাবি করেছে র‍্যাব। আজ শুক্রবার সকালে কারওয়ান বাজারের বিএসইসি ভবনে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ এ কথা জানান।
এখন খুবই সংক্ষিপ্তভাবে এ সংবাদগুলোর পেছনের ঘটনাটা কী জেনে নেয়া যাক।

প্রথম  আলোর উপরিউক্ত রিপোর্টটিতেই সেটা দেয়া আছে--
“গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান ২-এর ৯০ নম্বর সড়কে ইতালীয় নাগরিক সিজার তাবেলাকে (৫১) গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশ এই ঘটনায় বিএনপির কয়েকজন নেতাকে দায়ী করে।
ডিবি এর মধ্যে ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার এম এ কাইয়ুম, তাঁর ভাইসহ সাতজনকে আসামি করে তাবেলা হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে।”
ঘটনার সর্বশেষ আপডেট হচ্ছে, পুলিশের দেয়া অভিযোগপত্র অনুযায়ী ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ কাইয়ুমসহ সাতজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়ে গেছে। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে গতকাল মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) অভিযোগ গঠন করেছেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত। আগামী ২৪ নভেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করা হয়েছে।

তাবেলা হত্যা নিয়ে র‌্যাবের ‘ডকুমেন্ট ভিত্তিক’ নতুন দাবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার তিনদিন পরে আদালত পুলিশের অভিযোগত্র অনুযায়ী বিচার শুরু করল। দুটি আইনশৃংখলা বাহিনীর তদন্তের পর একটি ঘটনায় পরস্পর বিরোধী বক্তব্য বা তথ্য আসার এবং এরপর সর্বশেষ তথ্যতে উপেক্ষা করে বিচার শুরুর এই পরিস্থিতিটা কতটা স্পর্শকাতর তা শোনা যাক মানবাধিকার কর্মীদের মুখ থেকে।

২৫ অক্টোবর (মঙ্গলবার) প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে তুলে দিচ্ছি-- (এই রিপোর্ট নিয়ে পরে নিচের দিকে আরো কথা আসবে)
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান প্রথম আলোকে বলেছেন, “তাবেলা হত্যায় পুলিশ ও র‍্যাবের দুই ধরনের বক্তব্য আসায় মামলাটির দুর্বলতা চিহ্নিত হয়েছে। এর আগে মামলায় যে একটি পিস্তল উদ্ধার দেখানো হয়েছিল, ব্যালাস্টিক পরীক্ষায় এসেছে যে সেটি দিয়ে গুলি বের হয়নি। তাই বিভ্রান্তি কাটাতে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে মামলাটি পুনরায় তদন্তের জন্য আদালতে আবেদন করা উচিত।”
এখানে জেনে রাখা দরকার, আদালতে এই ‘পুনরায় তদন্তের আবেদন’টি তদন্তকারী কর্মকর্তাকে করতে হয়।

তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল তিনি পুনরায় তদন্তের আবেদন করবেন, কিন্তু তিনি করেননি। তিনি করেননি বলেই কি সব শেষ? তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপরই কি বিচার নির্ভর করে? আদালত বা বিচারকের কি এক্ষেত্রে কিছু করার আছে?

গত ২২ অক্টোবর (যেদিন তাবেলা হত্যা নিয়ে র‌্যাবের বক্তব্য পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে) বিশিষ্ট সাংবাদিক নুরুল কবীর সম্পাদিত নিউ এইজ পত্রিকার এডিটরিয়ালে এ সম্পর্কে কিছু কথা বলা হয়েছে। “Govt must explain Tavella murder claim conflicts". শিরোনামের এডিটরিয়াল থেকে কয়েকটি লাইন--
“Conversely, if the battalion’s claim about Sarwar Jahan’s involvement in the Tavella murder were to be true, the police investigation about the murder in question would in no way be correct and the murder case, in which an opposition activist is accused, now in trial stages would lose its significance and would not need to be acted on.
In the event of the battalion’s claim being true, the court of law should dispose of the case as being flawed, ask the police to explain their potentially flawed investigation and hold the police to account for their inefficiency. This is a question of the rule of law and a compromise on this would call into question the basic tenets of justice dispensation that no innocent people could be punished, and the guilty should be punished to deter the repeat of the offence and even if it does no good in deterring any future occurrence of the offence.”
প্যারা দুটির মূলকথা হচ্ছে, যদি র‌্যাবের দাবি সত্য হয়ে থাকে তাহলে আদালতের উচিত ত্রুটিযুক্ত মামলাটির ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্তে আসা এবং পুলিশকে তাদের ত্রুটি ও অদক্ষতার জন্য জবাবদিহীতার মুখোমুখি করা। অন্যথায় এটি ন্যায়াবিচারের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী কাজ হবে।

এখান থেকে বুঝা যায়, পুলিশের তদন্তে গাফিলতি বা ত্রুটি থাকলে তাদের জবাবদিহীতার মুখোমুখি করার সুযোগ আছে (বা করতেই হবে)। কিন্তু তাবেলার ঘটনার ক্ষেত্রে র‌্যাবের ধরিয়ে দেয়া গাফিলতি তো স্বীকার করছে না পুলিশ। সেজন্য তদন্ত কর্মকর্তা নতুন করে তদন্তের আবেদন করলেন না। এমতাবস্থায় আদালতের কি করনীয় কিছু আছে?

অবশ্যই আছে। আদালত স্বপ্রনোদিত হয়ে পুলিশকে র‌্যাবের নতুন দাবি সম্পর্কে জেনে বিস্তারিত আদালতকে অবহিত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা সরাসরি র‌্যাবকে তাদের কাছে থাকা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিতে পারেন। এরপর সেই ডকুমেন্ট গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হলে নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেবেন। কিন্তু আদালত এমন কিছু করেনি। পুলিশের আগের অভিযোগপত্র অনুসারেই বিচার শুরু করে দিয়েছে।

উপরে দেয়া মানবাধিকারকর্মীর বক্তব্য এবং একটি পত্রিকার এডিটরিয়ালে প্রকাশিত বক্তব্য অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, র‌্যাবের নতুন দাবির পর আগের অভিযোগপত্র অনুযায়ী তাবেলা হত্যার বিচার শুরু করার মাধ্যমে মামলার তদন্তকারী পুলিশ এবং আদালতের বিচারক তাদের নিজ নিজ পেশার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেনি। এবং এর ফলে নিরাপরাধ মানুষের সাজা ভোগের এবং প্রকৃত অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। এটাকে বলে ‘অবিচারের সংস্কৃতি’ (বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ একটু ভিন্ন জিনিস)।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমের যেসব দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন, তার মধ্যে বিচারহীনতা বা অবিচারের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া অন্যতম। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ হিসেবে নিজেকে দাবি করতে হলে বিচারহীনতা এবং অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই মিডিয়ার সামনে।

কিন্তু আমরা তাবেলা হত্যাকাণ্ডে কী দেখছি? মিডিয়া কি অবিচারের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে? নাকি ভিন্ন কোনো ভূমিকা পালন করছে এক্ষেত্রে? এখন সেটা একটু যাচাই করে দেখার চেষ্টা করবো।

২৬ অক্টোবরের এই পত্রিকাগুলোর সংবাদ ঘেঁটে দেখার সুযোগ হয়েছে-- দৈনিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, কালের কণ্ঠ, ইত্তেফাক, নয়াদিগন্ত, যুগান্তর, বাংলাদেশ প্রতিদিন, নিউ এইজ এবং ইনকিলাব- মোট ১০টি। তাবেলা হত্যা নিয়ে ১০টি পত্রিকার সংবাদের শিরোনাম নিচে দেয়া হল--

প্রথম আলো- র‍্যাব বলছে ‘নব্য জেএমবি’ দায়ী: বিচার শুরু বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে (প্রথম পাতা ডাবল কলাম)

ডেইলি স্টার- Tavella Murder Case: BNP's Quayum, brother among seven charged (শেষের পাতা ডাবল কলাম)

সমকাল- বিএনপি নেতা কাইয়ুমসহ ৭ জনের বিচার শুরু (৩য় পাতা ডাবল কলাম)

কালের কণ্ঠ- তাভেল্লা হত্যা মামলায় কাইয়ুমসহ সাতজনের বিচার শুরু (শেষের পাতা ডাবল কলাম)

ইত্তেফাক- তাভেলা সিজার হত্যা: বিএনপি নেতা কাইয়ুমসহ সাতজনের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন (প্রথম পাতা সিঙ্গেল কলাম)

নয়াদিগন্ত- তাভেলা সিজার হত্যা কাণ্ড: কাইয়ুমসহ ৭ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন (শেষের পাতা সিঙ্গেল কলাম)

যুগান্তর- সিজার তাভেল্লা হত্যার বিচার শুরু (প্রথম পাতা সিঙ্গেল কলাম)

বাংলাদেশ প্রতিদিন- তাভেলা সিজার হত্যা: বিএনপির কাইয়ুমসহ ৭ জনের বিচার শুরু (প্রথম পাতা সিঙ্গেল কলাম)

নিউ এইজ- BNP leader, six others indicted (প্রথম পাতা ডাবল কলাম)

ইনকিলাব- তাবেলা হত্যায় বিএনপি নেতাসহ ৭ জনের বিচার শুরু (প্রথম পাতা ডাবল কলাম)

খেয়াল করুন, ১০টি শিরোনামের ৯টি একই রকম। খুবই সাধারণ শিরোনাম, যদিও র‌্যাবের দাবির পর ঘটনাটি আর সাধারণ থাকেনি। চরমভাবে বিতর্কিত হয়ে গেছে। সেই বিতর্কিত হওয়ার বিষয়টি একমাত্র ফুটে ওঠেছে প্রথম আলোর শিরোনামে।

কভারেজের দিক থেকে বললেও প্রথম আলো সংবাদটিকে সর্বোচ্চ কভারেজ দিয়েছে। বেশিরভাগ পত্রিকা যেখানে শেষের পাতায় নিয়ে গেছে, কিংবা প্রথম পাতায় সিঙ্গেল করেছে, সেখানে প্রথম আলো ডাবল কলামে ছাপিয়েছে প্রথম পাতায়।

প্রতিদেবনগুলোর ভেতরে গিয়ে দেখা গেছে, চারটি পত্রিকা-- নয়াদিগন্ত, সমকাল, কালের কণ্ঠ এবং যুগান্তরে-- তাবেলা হত্যায় যে র‌্যাবের তদন্তে নতুন তথ্য উঠে এসেছে তার কোনোই উল্লেখ নেই, একটি শব্দও নেই! এমনকি শুনানিতে অংশ নেয়া আসামিপক্ষের আইনজীবীদের একটি কথাও নেই। যদিও রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুলিদের বক্তব্য আছে! এই পত্রিকাগুলোর রিপোর্টের পুরোটা জুড়েই মামলার প্রশ্নবিদ্ধ চার্জশীটের বক্তব্য এবং কোনো ক্ষেত্রে ‘তদন্ত সুত্র’র কথা উল্লেখ করে বক্তব্য রয়েছে।

এই চারটি পত্রিকার রিপোর্টের দুটি করে (প্রথম পাতা ও জাম্প পাতা) স্ক্রীনশট এখানে দেয়া হল--

নয়াদিগন্তের রিপোর্টের পূর্ণাঙ্গ স্ক্রীনশট-

সমকালের রিপোর্টের পূর্ণাঙ্গ স্ক্রীনশট-

কালের কণ্ঠের রিপোর্টের পূর্ণাঙ্গ স্ক্রীনশট-

যুগান্তরের রিপোর্টের পূর্ণাঙ্গ স্ক্রীনশট-

বাকি ছ’টি পত্রিকার মধ্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন ও ইনকিলাব একদম শেষের তিন/চার লাইনে র‌্যাবের দাবির কথা উল্লেখ করেছে। ইত্তেফাকের রিপোর্টে আসামিপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য এবং আলাদাভাবে “তাভেলা হত্যায় জঙ্গিরা জড়িত: র‌্যাব মহাপরিচালক” উপশিরোনামে কিছু কথা তুলে দিয়েছে। একই রকমভাবে নিউ এইজও আইনজীবীর বক্তব্য এবং এর বাইরে একাধিক প্যারায় র‌্যাবের দাবির কথা বলেছে।

ডেইলি স্টার শিরোনাম এবং ইন্ট্রোতে র‌্যাবের দাবি নিয়ে কিছু না বলেও প্রতিবেদনের মধ্যাংশ থেকে তাবেলা হত্যায় আইএসের দায় স্বীকার, র‌্যাবের নতুন তথ্য এবং সেগুলো আবার ডিএমিপর কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যান সংক্রান্ত বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। শেষাংশে র‌্যাবের বক্তব্যকে হাইলাইট করে বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্যও ছাপানো হয়েছে।

এখানে একটি বিষয় স্বরণ করা যায়, ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসের ২৬ তারিখ পুলিশের সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতা কাইয়ুমের সংশ্লিষ্টতার ইঙ্গিত দিয়ে যেসব বক্তব্য দেয়া হয়েছিল পরদিন ২৭ অক্টোবর ডেইলি স্টার সেই বক্তব্যের আলোকে ‘who is the big brother?’ শিরোনামে লীড নিউজ করেছিল। তার পরদিন আবারও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামানের বরাতে (যে বক্তব্য পরে মন্ত্রী অস্বীকার করেছেন) ‘BNP leader Quayum the 'big brother’ শিরোনামে লীড নিউজ করে পত্রিকাটি। সেই কভারেজের তুলনায় বিএনপি নেতার ‘পক্ষে যাওয়া’ র‌্যাবের বক্তব্যের যে গৌণ কভারেজ দিয়েছে ডেইলি স্টার তা একদম কমিয়ে বললেও ‘খুবই দৃষ্টিকটু’ বলতে হবে।

তাবেলা হত্যার বিচার শুরু নিয়ে প্রথম আলোর রিপোর্টটি ছিল সবচেয়ে সেন্সিবল। প্রথমত, শিরোনামে অভিযোগ নিয়ে পুলিশ ও র‌্যাবের বক্তব্যের বৈপরীত্যটা ফুটে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, ইন্ট্রোতে এবং পুরো রিপোর্টেও এটি রিফলেক্টেড হয়েছে। তৃতীয়ত, রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের আইনজীবীর বাইরে গিয়ে তৃতীয় একজন আইন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য দিয়ে এই পরিস্থিতির জঠিলতাটি ফুটিয়ে তোলার মোটামুটি একটা চেষ্টা করা হয়েছে। চতুর্থত, অভিযুক্তের স্বজনেরও বক্তব্য যোগ করা হয়েছে। এবং সবশেষে একজন খ্যাতিমান মানবাধিকার কর্মীর বক্তব্য রিপোর্টটিকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। এক কথায়, বাকি নয়টি পত্রিকার রিপোর্টের যে ‘স্লান্ট’ বা দৃষ্টিকোণ ছিল, তাতে যেভাবে ঘটনার একপক্ষের (রাষ্ট্রপক্ষ) ভাষ্য প্রাধ্যান্য (কোনো ক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে) পেয়েছে, এবং অন্যপক্ষে ভাষ্য চাপা পড়ে গেছে, প্রথম আলোর রিপোর্ট তার থেকে মুক্ত বলা যাবে।

প্রথম আলো বাদ দিয়ে বাকি ৯টি পত্রিকার রিপোর্টে মোটা দাগে তিনটি বিষয় স্পষ্ট--

এক. বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতার পক্ষে যেতে পারে, রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনীর তদন্ত ভিত্তিক এমন ‘প্রামাণ্য’ তথ্যকে একেবারে আড়াল দেয়া কিংবা গৌণ হিসেবে উপস্থাপনের প্রবণতা।

দুই. মামলার অভিযুক্ত এবং অভিযোগকারী উভয়পক্ষের মধ্যে অভিযোগকারী রাষ্ট্রপক্ষের পুলিশি ও গোয়েন্দা ভাষ্যকে একচেটিয়া প্রাধান্য দেয়া। অভিযুক্তের ভয়েসকে একেবারে ‘নাই’ করে দেয়ারও প্রচেষ্টাও কোনো কোনো পত্রিকায় লক্ষ্যণীয়।

তিন.  র‌্যাবের দাবির পর প্রশ্নবিদ্ধ অভিযোগপত্রে বিচার শুরুর বিষয়টিকে কেন্দ্র করে থাকা সম্ভাব্য অবিচার এবং মানবাধিকার লংঘনের আশংকাকে মোটেও আমলে না নেয়া।

সরকারি বাহিনীর এমন প্রশ্নবিদ্ধ আচরণকে প্রশ্ন না করে নির্দ্বিধায় ঘটতে দেয়া, এবং ক্ষেত্রবিশেষ সরকারপক্ষের প্রশ্নবিদ্ধ ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সহায়তা করা অবিচারের সংস্কৃতিতে প্রত্যক্ষ সহায়তারই নামান্তর।

২টি মন্তব্য: