গত ১৫ অক্টোবর পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। সেখানে তাদের সাম্প্রতিক একটি গবেষণার ব্যাপারে গণমাধ্যমকে অবহিত করা হয়। গবেষণাটির টাইটেল ‘মাইক্রোবিড পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন হুমকি’।
মাইক্রোবিডকে বাংলায় বলা হয় ‘প্লাস্টিক কণা’ বা ‘প্লাস্টিক দানা’। প্রসাধন দ্রব্যে এটির ব্যবহার হয়ে থাকে। যদিও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে প্লাস্টিক কণার ব্যবহার নিষিদ্ধের বিলে স্বাক্ষর করেন। ফেব্রুয়ারিতে কানাডা এটিকে ‘বিষাক্ত দ্রব্য’ (টক্সিক সাবস্টেন্স) হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর গত সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটেন সরকারও ঘোষণা দেয় ২০১৭ সাল থেকে দেশটিতে প্লাস্টিক কণার ব্যবহার সম্পুর্ণ বন্ধ করে দেয়া হবে। অন্যান্য দেশও একই পথ অনুসরণ করছে।
প্লাস্টিক কণার ক্ষতির দিকটা কী?
বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ ঘেঁটে দেখা গেল, মানব শরীর এবং পরিবেশ উভয়ের জন্য এটির মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। গায়ে ব্যবহৃত প্রসাধনী থেকে লোমকূপে জমে ত্বকের ক্ষতি করে। ত্বকের কোষ নষ্ট করে দেয়। বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় এসব প্লাস্টিক কণা। এর কারণে বাধাগ্রস্ত হয় হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া। বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ হতে পারে ক্যান্সারেরও। অন্যদিকে পরিবেশের ক্ষেত্রে ক্ষতি আরো বিস্তীর্ণ। গোসল বা কাপড় ধোয়ার পর পানিতে মিশে যাওয়া কণা চলে যাচ্ছে খাল-বিল-নদী ও সমু্দ্রে। সে পানিতে থাকা মাছ এটি গ্রহণ করছে তাদের শরীরে। সেখান থেকে আবার মানব শরীরের ভেতরে প্রবেশ করছে ক্ষতিকর কণাটি। মাছ এবং মানুষ উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দিতে ভূমিকা রাখার জোরালো আশংকা রয়েছে এতে।
এসডো’র সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশের মার্কেট থেকে সংগৃহীত ফেসওয়াশ, ফেসিয়াল, স্ক্রাব, টুথপেস্টসহ বিবিধ পণ্যসামগ্রী পরীক্ষা করে প্লাস্টিক কণার ব্যাপকহারে উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যাপকতার বিষয়ে ধারণা দিতে গিয়ে আরো জানানো হয়, ফেসওয়াশ, টুথপেস্ট ও ডিটারজেন্ট থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে প্রতি মাসে নির্গত হচ্ছে ৭ হাজার ৯২৮ বিলিয়ন প্লাস্টিক কণা।
এই সংবাদ সম্মেলনে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরদিনের (১৬ অক্টোবর) পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার কথা। তবে সবাই খবরটি ছাপায়নি। কেউ কেউ ছাপিয়েছে।
শীর্ষ স্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকা ঘেঁটে খবরটি পাওয়া গেছে মাত্র চারটিতে। এর মধ্যে দৈনিক বণিক বার্তা প্রথম পাতায় লীড নিউজ হিসেবে প্রকাশ করে “নিজেদের ঘোষণা বাংলাদেশে মানছে না ইউনিলিভার” শিরোনামে।
ডেইলি স্টার প্রথম পাতায় তিন কলামে সেকেন্ড লীড হিসেবে প্রকাশ করে “Tiny Plastic, Huge Risk” শিরোনামে।
নয়াদিগন্ত ছাপিয়েছে তৃতীয় পাতায় ডাবল কলামে। আর দৈনিক মানবজমিনে সিঙ্গেল কলাম। জনস্বার্থের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটি নিয়ে সমকাল, কালের কণ্ঠ, ইত্তেফাক, যুগান্তর ও ইনকিলাবে কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।
যে চারটি পত্রিকা খবরটি প্রকাশ করেছে তাদের তথ্য উপস্থাপনের ধরনটি ছিল লক্ষ্যণীয়।
ডেইলি স্টার, নয়াদিগন্ত এবং মানবজমিন গবেষণার জন্য যেসব কোম্পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল সেগুলোর নাম প্রকাশ করেনি। তাদের রিপোর্টের লক্ষ্য ছিল প্লাস্টিক কণার ক্ষতির দিক তুলে ধরা। কোন কোন কোম্পানির পন্যে এটি পাওয়া যাচ্ছে, বা বেশি পাওয়া গেছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
নমুনা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম রিপোর্টে প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে ‘সাংবাদিকতার নৈতিকতা’র জায়গা থেকে পক্ষে-বিপক্ষে আলাপের সুযোগ আছে। আমরা সেদিকে না যাই।
এর বাইরে যেটা লক্ষ্য করার মতো তা হচ্ছে, বণিক বার্তার রিপোর্টটির ভিন্ন ‘স্লান্ট’ বা দৃষ্টিকোণ। এই পত্রিকাটিও বলতে গেলে নমুনা-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নাম প্রকাশ করেনি।
তবে তারা এসডোর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া তথ্যকে উপলক্ষ্য করে নমুনা-সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি ইউনিলিভারের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে (শঠতা) তুলে ধরেছে। এটা তুলে ধরতে গিয়ে ইউনিলিভারের পণ্যে কী পরিমাণ প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি ধরা পড়েছে গবেষণায় তা উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউনিলিভারের শঠতা হচ্ছে এই-
উন্নত বিভিন্ন দেশে বিগত বছরগুলোতে প্লাস্টিক কণা নিষিদ্ধের দাবি উঠার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী নিজেদের সব পণ্য প্লাস্টিক কণামুক্ত করার ঘোষণা দেয় ইউনিলিভার। কিন্তু বাংলাদেশে নিজেদের সেই ঘোষণার বিপরীত কাজ করছে। উচ্চমাত্রায় প্লাস্টিক কণা-যুক্ত পণ্য বিক্রি করছে, যা এসডোর গবেষণায় প্রমাণিত।
বণিক বার্তার রিপোর্টের এই দৃষ্টিকোণটি চমৎকার। বিজনেস সাংবাদিকতা করার কারণে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার হয়তো আগে থেকেই ইউনিলিভারের ঘোষণা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ফলে এসডোর তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে তার মাথায় এই ধরনের একটি রিপোর্টের আইডিয়া আসে।
তার রিপোর্টে মূলত প্লাস্টিক কণা বিষয়ক এসডোর গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনা-সংশ্লিষ্ট কোনো কোম্পানির নাম প্রকাশ করার উদ্দেশ্য ছিলনা। বরং ভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা-সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানির ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তুলে ধরাই লক্ষ্য। ফলে তার রিপোর্টটি ‘সাংবাদিকতার নৈতিকতা’ সংক্রান্ত উপরে উল্লিখিত বিতর্কের উর্ধ্বে। অর্থাৎ, রিপোর্টার বা তার পত্রিকাকে এখন গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এটা বলতে পারবে না যে, “আমরা তো আপনাকে নমুনা-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির/গুলোর নাম প্রকাশ করার জন্য তথ্য দেইনি। আপনি কেন এটা প্রকাশ করলেন?”
ডেইলি স্টার বাংলাদেশের প্রধান এবং সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ইংরেজি পত্রিকা। অপেক্ষাকৃত নতুন বণিক বার্তার সুনাম স্টারের ধারে কাছেও নয়। এসডোর গবেষণাকে উপলক্ষ্য করে পত্রিকা দুটির রিপোর্ট দুটি পাশাপাশি পড়ে পাঠক হিসেবে একটু আফসোস লাগলো- বণিক বার্তার রিপোর্টটা তো আসলে ডেইলি স্টারেই হওয়া উচিত ছিল! স্টারের বিজনেস রিপোর্টাররা তো বাংলাদেশের বাইরের বিজনেস বিষয়ক খবরা খবর বাংলা বণিক বার্তার রিপোর্টারদের চেয়ে বেশি রাখার কথা। আরো অন্যান্য বিষয় আছে। সবমিলিয়ে যে কোনো ইস্যুতে অন্যদের চেয়ে স্টারের রিপোর্টের ওজন একটু হলেও বেশি হওয়াই উচিত!
তারপর মনে হল, সব রিপোর্টার সব ইস্যুতে সবকিছু খবর রাখবেন তা স্বাভাবিক নয়। সব সময় সব পত্রিকা সব ইস্যুতেই সেরা রিপোর্ট করে পাঠককে পড়তে দিতে পারবে এটা আশা করা অন্যায়। হয়তো ইউনিলিভারের বিশ্বব্যাপী ঘোষণাটি স্টারের সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের অবগতির মধ্যে ছিল না। ফলে উনি স্রেফ এসডোর গবেষণার ফাইন্ডিংসের ওপর একটি সাদামাঠা রিপোর্ট লিখে দিয়েছেন। যথেষ্ট তথ্য থাকলে হয়তো ডেইলি স্টারও এরকম রিপোর্ট ছাপাতো। এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তাদের সাথে প্রতারণকারী একটি মুনাফালোভীর ব্যাপারে কিছুটা হলেও সচেতন হতে পারতো।
কিন্তু মন থেকে খটকা না যাওয়ায় চিন্তা করলাম, দেখি না একটু ঘেঁটে ডেইলি স্টার আর ইউনিলিভারের সম্পর্কটা কেমন? মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ এর জোরে ‘বিশেষ ছাড়’ এর আওতায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে স্টার ‘স্বেচ্চায় উদাসীন’ কিনা? স্টারের মালিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম এর কথা মাথায় রাখলে মাল্টিন্যাশনালগুলোর প্রতি স্টারের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ এর প্রসঙ্গটি ভুলা যায় না তো!
তো, অনলাইনে ঘাঁটাঘাটি করে স্টার-ইউনিলিভার সম্পর্ক নিয়ে যা পাওয়া গেল তা তুলে ধরা হল নিচে।
১৯ অক্টোবর (২০১৬) রাতে ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইট www.thedailystar.net এ গিয়ে ডান দিকের Search অপশনে unilever লিখে সার্চ দেয়ার পর ১০টি পৃষ্ঠা ক্রমান্বয়ে ওপেন হয়। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ১০টি করে সংবাদ আসে। এতে মোট ১০০টি সংবাদ পাওয়া গেছে। এই লিংকে সরাসরি ক্লিক করেও দেখা যেতে পারে সংবাদগুলো- http://www.thedailystar.net/google/search .
এই ১০০টি সংবাদের শেষের দিকের ৪/৫টি বাদে সবগুলোই সরাসরি ইউনিলিভার বাংলাদেশ (কয়েকটি অবশ্য অন্যদেশের শাখারও আছে) সংক্রান্ত সংবাদ। ছাপা হওয়ার তারিখের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ক্রম মেনে সার্চ রেজাল্ট আসেনি। সংবাদগুলো গত কয়েক বছরের র্যান্ডম তারিখে এসেছে। গত তিন চার বছরের প্রতিবেদনই বেশি। তবে দুয়েকটি ২০০৮/০৯/১০ ইত্যাদি সালেরও আছে।
নিশ্চিত করে বলা যায়, ডেইলি স্টারে ২০০৮ সাল বা তার পরে থেকে ইউনিলিভার সংক্রান্ত মাত্র এই ১০০টি সংবাদ ছাপা হয়নি। প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। প্রিন্টেড কপি একটি একটি করে দেখলে হয়তো কয়েকগুণ বেশি সংবাদ মিলবে। তবে আপপতত বিকল্প না থাকায় যাচাই বাছাইয়ের জন্য আমরা সাধারণ নমুনা হিসেবে এই ১০০টি সংবাদকে নিতে পারি।
১০০টি প্রতিবেদনের সব ক’টির শিরোনাম এবং বেশ কয়েকটির ভেতরের কন্টেন্টও পড়েছি। দুই ধরনের সংবাদ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখেছি। প্রথমত, কোম্পানিটির বিভিন্ন ছোটবড় ইভেন্টের প্রেসরিলিজ-নির্ভর সংবাদ। দ্বিতীয়, কোম্পানি বা এটির বিভিন্ন অনুসঙ্গ নিয়ে বিশেষ কভারেজে প্রকাশিত সুনাম-গাওয়া বিশেষ ফিচার, আর্টিকেল এবং কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার।
১০০টি সংবাদের মধ্যে নেতিবাচক বলতে একটি শিরোনাম পাওয়া যায়। এবং সেটি কোনো বিশেষ প্রতিবেদন নয়, বরং একটি ডে-ইভেন্ট টাইপের সংবাদ। তার চেয়েও বড় কথা, এটি ইউনিলিভার বাংলাদেশ সংক্রান্ত নয়।
শিরোনামটি হচ্ছে- EU fines Unilever, P&G for detergent price-fixing.
সুনাম-গাওয়া প্রেসরিলিজ-নির্ভর এবং বিশেষ সংবাদ/সাক্ষাৎকার প্রতিবেদনগুলোর কিছু শিরোনাম তুলে দিচ্ছি--
Unilever funds setting up OT, ICU
Unilever starts tree plantation programme
95,000 schoolkids to get nutritious biscuits
375 students get scholarship from Fair & Lovely Foundation
100 poor families get water purifiers
Unilever stands by Sidr-hit people
Unilever awards employees
Unilever No.1 employer in FMCG: survey
Unilever, third most sought-after employer: LinkedIn study
The most shared advertisement in Asia
Unilever official wins 'CNBC Asia Business Leader of the Year' award
CSR heroes awarded
Business heroes honoured
Unilever Bangladesh's ad wins global award
Dissecting the success of Unilever Bangladesh
Unilever goes from strength to strength
WHERE WOMEN CAN SHINE
Unilever Internship: A winning start to career
একটি পাক্কা ‘পাবলিক রিলেশন্স’ প্রতিষ্ঠানের চিত্র! প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদনের সাথে এক বা একাধিক ছবি রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিবেদন ডেইলি স্টারের সাপলিমেন্টারি ম্যাগাজিনগুলোতে কভার স্টোরি হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে।
স্টারের ওয়েবসাইটে unilever ট্যাগ ক্লিক করলে এই লিংকটি ওপেন হয়-- http://www.thedailystar.net/tags/unilever
এখানে মোট সাতটি সংবাদ দেখা গেছে ১৯ অক্টোবর রাত পর্যন্ত। যার মধ্যে দুটি প্রতিবেদন উপরের ১০০টির মধ্যে পাওয়া যায়। বাকি পাঁচটি বিউটি টিপস বিষয়ক এবং একটি বিদেশী সংবাদ (ইউনিলিভার সংক্রান্ত)।
এই ট্যাগ-এও কোম্পানিটি সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক সংবাদ নেই।
Google এ unilever thedailystar.net লিখে সার্চ দেয়ার পর প্রথম তিন পৃষ্ঠায় যেসব নিউজ আসে তার সবগুলো উপরে বর্ণিত ১০০টির মধ্যেই আছে। চতুর্থ পৃষ্ঠা থেকে সরাসরি স্টারের নিউজ আসে না।
আপাতত অনলাইনে এর বেশি যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই (তবে ভবিষ্যতে নেয়ার চেষ্টা থাকবে!)।
শুধু ডেইলি স্টারের ইউনিলিভার সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোর হালহকিকত দেখলে যে কারো কাছে মনে হতে পারে, এই মাল্টিন্যাশনালটি অত্যন্ত পুতঃপবিত্র এবং জনমানুষের কল্যাণে নিবেদিত একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান! যার কাজ হল মানুষের কল্যাণ করতে করতে তারপর কিছু পয়সা বেঁচে গেলে তা প্রফিট হিসেবে নেয়া!! কোনো কোম্পানির নিজস্ব ‘পাবলিক রিলেশন্স’ বিভাগ বা প্রচারণার জন্য চুক্তিবদ্ধ কোনো থার্ড পার্টিকে দিয়ে ডেইলি স্টারের মতো করে এত সুষ্ঠুভাবে নিজেদের পক্ষে ক্যাম্পেইন করিয়ে নেয়া সম্ভব হতো কিনা কে জানে!
ডেইলি স্টারের দেয়া এই ‘ধারণা’র বিপরীতে এখন দেখা যাক ইউনিলিভার বাংলাদেশ নিয়ে বাংলাদেশি অন্য কয়েকটি পত্রিকায় বিগত দুই বছরে কী ধরনের নেতিবাচক সংবাদ এসেছে? দুই তিনটি উদাহরণ অনলাইন থেকেই দেয়া হল--
১৭ অক্টোবর (২০১৬) বাংলানিউজের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম- “ইউনিলিভারের ৭৩ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি, তদন্তে কাস্টমস”।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
এই প্রতিবেদনে বলা হয়-
বাংলানিউজের প্রতিবেদনের সত্য-মিথ্যা নিয়ে অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন। তবে যুগান্তরের রিপোর্টের ক্ষেত্রে এটা বলা যায়, যেহেতু এই পত্রিকার বিরুদ্ধে গত দু্ই বছরেও এই প্রতিবেদনের কারণে কোনো মামলা দায়ের করেনি ইউনিলিভার, ফলে রাজস্ব ফাঁকির তথ্যের সত্যতা প্রশ্নাতীত।
আপাতত এটুকুই থাকুক। এখন শুধু ইউনিলিভার এর অন্যান্য দেশীয় কিছু অপকর্মের খতিয়ান দিয়ে রাখা যায়।
1. Unilever: Corporate Crimes (Corporate Watch)
2. Unilever To Pay $4.5 Million for Environmental Crimes
3. Unilever’s alleged crimes in India made public thanks to Nicki Minaj-inspired rap song (New York Times)
4. Unilever accused over rainforest destruction (The Telegraph)
5. SHOCKING HISTORY: UNILEVER EXPOSED
এত কিছু দেখার পর এ পর্যায়ে এসে মনে হল--
এক. ইউনিলিভার কোনো পুতঃপবিত্র কোম্পানি নয়। বাংলাদেশেই তার বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি, বিনা কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি , ঘোষণা দিয়েও প্লাস্টিক কণা পণ্যে মেশানোর মাধ্যমে মানুষের ও পরিবেশের ক্ষতি করা ইত্যাদি গুরুত্বর অপরাধের অভিযোগ ও প্রমাণ আছে। এসব বহু বছর ধরে করে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
দুই. কিন্তু ডেইলি স্টারের র্যান্ডমলি খুঁজে পাওয়া ১০০টির বেশি সংবাদের মধ্যে সেসব অপরাধের কোনো নাম-গন্ধও নেই। আছে শুধু সুনাম আর সুনাম। কোথায় কী ধরনের সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করছে, কোথায় করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি পালন করছে তার খবর। ঝমকালো উপস্থানায় ইতিবাচক যাবতীয় খবর (বেশিরভাগই সরবরাহকৃত প্রেসরিলিজ নির্ভর)।
তিন. এমন অবস্থায় ডেইলি স্টারে প্লাস্টিক কণা নিয়ে করা প্রতিবেদনে ইউনিলিভারের শঠতা ধরিয়ে দেয়ার আশা করা ঠিক হয়নি আমার! এবং এটাও মনে করা ভুল হয়েছে যে, তথ্যের অভাবে এই শঠতা ধরিয়ে দিতে পারেনি পত্রিকাটি। বরং বণিক বার্তার মতো ইউনিলিভারের আন্তর্জাতিক ঘোষণাটি সম্পর্কে অবগত থাকলেও (ধরে নেয়া যায় অবগত ছিল) ডেইলি স্টার কোম্পানিটির শঠতা ধরিয়ে দিত না।
বাঙালি সংস্কৃতিতে ভাসুর হলেন স্বামীর বড় ভাই। তিনি বিনা প্রশ্নে সম্মান পাওয়ার মতো একজন ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। তার ভুলশদ্ধ-অপরাধের কোনো বালাই নেই। সর্ব সময়ে নমস্য তিনি! এমন নমস্য যে, অসম্মান হবার শংকায় তার নাম মুখে নিতেও মানা আছে! ভাসুরের কোনো খারাপ তো দূরের কথা, ভাল কিছুর বর্ণনায়ও নাম মুখে নেয়া যাবে না।
আধুনিক সময়ে ‘সাংবাদিকতার ব্যবসায়’ও ভাসুর সংস্কৃতি খুবই জোরালোভাবে হাজির। এখানে ভাসুর হলেন মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলো। তারা মিডিয়ার ভাসুর। বাঙালি ভাসুরের সাথে করপোরেট ভাসুরের পার্থক্য হচ্ছে, পরের ভাসুরের সুনাম করার সময় নাম মুখে নিয়ে ঢোল বাজিয়ে সবাইকে শোনানে যাবে। কিন্তু দুর্নামের কিছু হলে আর ভাসুরের নাম মুখে নেয়া যাবে না!
ডেইলি স্টার ‘সাংবাদিকতার ব্যবসা’র এই সংস্কৃতির ইজ্জত রেখেছে এবং রাখছে। তার অন্যতম ভাসুর ইউনিলিভারের নাম মুখে নিয়ে কোনো বদনাম করেনি এবং আশা করা যায় করবেও না। সেটা প্লাস্টিক কণা সংক্রান্ত সংবাদের ক্ষেত্রে হোক আর অন্যক্ষেত্রেই হোক।
আলোচ্য ভাসুরের সাথে স্টারের যে ধরনের সম্পর্ক উপরে চিত্রিত হয়েছে সেটাকে কেউ ‘আপত্তিকর’ বলে অভিযোগ করলেও করতে পারেন। কিন্তু তাকে মনে রাখতে হবে, এর কারণে পত্রিকাটির ‘নীতিনৈতিকতাপূর্ণ সাংবাদিকতা’ মার খেয়ে যাবে না!
মাইক্রোবিডকে বাংলায় বলা হয় ‘প্লাস্টিক কণা’ বা ‘প্লাস্টিক দানা’। প্রসাধন দ্রব্যে এটির ব্যবহার হয়ে থাকে। যদিও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে পশ্চিমা দেশগুলোতে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে প্লাস্টিক কণার ব্যবহার নিষিদ্ধের বিলে স্বাক্ষর করেন। ফেব্রুয়ারিতে কানাডা এটিকে ‘বিষাক্ত দ্রব্য’ (টক্সিক সাবস্টেন্স) হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর গত সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটেন সরকারও ঘোষণা দেয় ২০১৭ সাল থেকে দেশটিতে প্লাস্টিক কণার ব্যবহার সম্পুর্ণ বন্ধ করে দেয়া হবে। অন্যান্য দেশও একই পথ অনুসরণ করছে।
প্লাস্টিক কণার ক্ষতির দিকটা কী?
বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধ ঘেঁটে দেখা গেল, মানব শরীর এবং পরিবেশ উভয়ের জন্য এটির মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। গায়ে ব্যবহৃত প্রসাধনী থেকে লোমকূপে জমে ত্বকের ক্ষতি করে। ত্বকের কোষ নষ্ট করে দেয়। বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায় এসব প্লাস্টিক কণা। এর কারণে বাধাগ্রস্ত হয় হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া। বিশেষ ক্ষেত্রে কারণ হতে পারে ক্যান্সারেরও। অন্যদিকে পরিবেশের ক্ষেত্রে ক্ষতি আরো বিস্তীর্ণ। গোসল বা কাপড় ধোয়ার পর পানিতে মিশে যাওয়া কণা চলে যাচ্ছে খাল-বিল-নদী ও সমু্দ্রে। সে পানিতে থাকা মাছ এটি গ্রহণ করছে তাদের শরীরে। সেখান থেকে আবার মানব শরীরের ভেতরে প্রবেশ করছে ক্ষতিকর কণাটি। মাছ এবং মানুষ উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা কমিয়ে দিতে ভূমিকা রাখার জোরালো আশংকা রয়েছে এতে।
এসডো’র সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সম্প্রতি বাংলাদেশের মার্কেট থেকে সংগৃহীত ফেসওয়াশ, ফেসিয়াল, স্ক্রাব, টুথপেস্টসহ বিবিধ পণ্যসামগ্রী পরীক্ষা করে প্লাস্টিক কণার ব্যাপকহারে উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যাপকতার বিষয়ে ধারণা দিতে গিয়ে আরো জানানো হয়, ফেসওয়াশ, টুথপেস্ট ও ডিটারজেন্ট থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে প্রতি মাসে নির্গত হচ্ছে ৭ হাজার ৯২৮ বিলিয়ন প্লাস্টিক কণা।
এই সংবাদ সম্মেলনে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরদিনের (১৬ অক্টোবর) পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হওয়ার কথা। তবে সবাই খবরটি ছাপায়নি। কেউ কেউ ছাপিয়েছে।
শীর্ষ স্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকা ঘেঁটে খবরটি পাওয়া গেছে মাত্র চারটিতে। এর মধ্যে দৈনিক বণিক বার্তা প্রথম পাতায় লীড নিউজ হিসেবে প্রকাশ করে “নিজেদের ঘোষণা বাংলাদেশে মানছে না ইউনিলিভার” শিরোনামে।
ডেইলি স্টার প্রথম পাতায় তিন কলামে সেকেন্ড লীড হিসেবে প্রকাশ করে “Tiny Plastic, Huge Risk” শিরোনামে।
যে চারটি পত্রিকা খবরটি প্রকাশ করেছে তাদের তথ্য উপস্থাপনের ধরনটি ছিল লক্ষ্যণীয়।
ডেইলি স্টার, নয়াদিগন্ত এবং মানবজমিন গবেষণার জন্য যেসব কোম্পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল সেগুলোর নাম প্রকাশ করেনি। তাদের রিপোর্টের লক্ষ্য ছিল প্লাস্টিক কণার ক্ষতির দিক তুলে ধরা। কোন কোন কোম্পানির পন্যে এটি পাওয়া যাচ্ছে, বা বেশি পাওয়া গেছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
নমুনা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নাম রিপোর্টে প্রকাশের বিষয়টি নিয়ে ‘সাংবাদিকতার নৈতিকতা’র জায়গা থেকে পক্ষে-বিপক্ষে আলাপের সুযোগ আছে। আমরা সেদিকে না যাই।
এর বাইরে যেটা লক্ষ্য করার মতো তা হচ্ছে, বণিক বার্তার রিপোর্টটির ভিন্ন ‘স্লান্ট’ বা দৃষ্টিকোণ। এই পত্রিকাটিও বলতে গেলে নমুনা-সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর নাম প্রকাশ করেনি।
তবে তারা এসডোর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া তথ্যকে উপলক্ষ্য করে নমুনা-সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি ইউনিলিভারের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে (শঠতা) তুলে ধরেছে। এটা তুলে ধরতে গিয়ে ইউনিলিভারের পণ্যে কী পরিমাণ প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি ধরা পড়েছে গবেষণায় তা উল্লেখ করা হয়েছে।
ইউনিলিভারের শঠতা হচ্ছে এই-
উন্নত বিভিন্ন দেশে বিগত বছরগুলোতে প্লাস্টিক কণা নিষিদ্ধের দাবি উঠার প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী নিজেদের সব পণ্য প্লাস্টিক কণামুক্ত করার ঘোষণা দেয় ইউনিলিভার। কিন্তু বাংলাদেশে নিজেদের সেই ঘোষণার বিপরীত কাজ করছে। উচ্চমাত্রায় প্লাস্টিক কণা-যুক্ত পণ্য বিক্রি করছে, যা এসডোর গবেষণায় প্রমাণিত।
বণিক বার্তার রিপোর্টের এই দৃষ্টিকোণটি চমৎকার। বিজনেস সাংবাদিকতা করার কারণে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার হয়তো আগে থেকেই ইউনিলিভারের ঘোষণা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ফলে এসডোর তথ্য পাওয়ার সাথে সাথে তার মাথায় এই ধরনের একটি রিপোর্টের আইডিয়া আসে।
তার রিপোর্টে মূলত প্লাস্টিক কণা বিষয়ক এসডোর গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনা-সংশ্লিষ্ট কোনো কোম্পানির নাম প্রকাশ করার উদ্দেশ্য ছিলনা। বরং ভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা-সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানির ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তুলে ধরাই লক্ষ্য। ফলে তার রিপোর্টটি ‘সাংবাদিকতার নৈতিকতা’ সংক্রান্ত উপরে উল্লিখিত বিতর্কের উর্ধ্বে। অর্থাৎ, রিপোর্টার বা তার পত্রিকাকে এখন গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান এটা বলতে পারবে না যে, “আমরা তো আপনাকে নমুনা-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির/গুলোর নাম প্রকাশ করার জন্য তথ্য দেইনি। আপনি কেন এটা প্রকাশ করলেন?”
ডেইলি স্টার বাংলাদেশের প্রধান এবং সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস ইংরেজি পত্রিকা। অপেক্ষাকৃত নতুন বণিক বার্তার সুনাম স্টারের ধারে কাছেও নয়। এসডোর গবেষণাকে উপলক্ষ্য করে পত্রিকা দুটির রিপোর্ট দুটি পাশাপাশি পড়ে পাঠক হিসেবে একটু আফসোস লাগলো- বণিক বার্তার রিপোর্টটা তো আসলে ডেইলি স্টারেই হওয়া উচিত ছিল! স্টারের বিজনেস রিপোর্টাররা তো বাংলাদেশের বাইরের বিজনেস বিষয়ক খবরা খবর বাংলা বণিক বার্তার রিপোর্টারদের চেয়ে বেশি রাখার কথা। আরো অন্যান্য বিষয় আছে। সবমিলিয়ে যে কোনো ইস্যুতে অন্যদের চেয়ে স্টারের রিপোর্টের ওজন একটু হলেও বেশি হওয়াই উচিত!
তারপর মনে হল, সব রিপোর্টার সব ইস্যুতে সবকিছু খবর রাখবেন তা স্বাভাবিক নয়। সব সময় সব পত্রিকা সব ইস্যুতেই সেরা রিপোর্ট করে পাঠককে পড়তে দিতে পারবে এটা আশা করা অন্যায়। হয়তো ইউনিলিভারের বিশ্বব্যাপী ঘোষণাটি স্টারের সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের অবগতির মধ্যে ছিল না। ফলে উনি স্রেফ এসডোর গবেষণার ফাইন্ডিংসের ওপর একটি সাদামাঠা রিপোর্ট লিখে দিয়েছেন। যথেষ্ট তথ্য থাকলে হয়তো ডেইলি স্টারও এরকম রিপোর্ট ছাপাতো। এবং এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ তাদের সাথে প্রতারণকারী একটি মুনাফালোভীর ব্যাপারে কিছুটা হলেও সচেতন হতে পারতো।
কিন্তু মন থেকে খটকা না যাওয়ায় চিন্তা করলাম, দেখি না একটু ঘেঁটে ডেইলি স্টার আর ইউনিলিভারের সম্পর্কটা কেমন? মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি হিসেবে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ এর জোরে ‘বিশেষ ছাড়’ এর আওতায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে স্টার ‘স্বেচ্চায় উদাসীন’ কিনা? স্টারের মালিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সকম এর কথা মাথায় রাখলে মাল্টিন্যাশনালগুলোর প্রতি স্টারের ‘বিশেষ সম্পর্ক’ এর প্রসঙ্গটি ভুলা যায় না তো!
তো, অনলাইনে ঘাঁটাঘাটি করে স্টার-ইউনিলিভার সম্পর্ক নিয়ে যা পাওয়া গেল তা তুলে ধরা হল নিচে।
১৯ অক্টোবর (২০১৬) রাতে ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইট www.thedailystar.net এ গিয়ে ডান দিকের Search অপশনে unilever লিখে সার্চ দেয়ার পর ১০টি পৃষ্ঠা ক্রমান্বয়ে ওপেন হয়। প্রতিটি পৃষ্ঠায় ১০টি করে সংবাদ আসে। এতে মোট ১০০টি সংবাদ পাওয়া গেছে। এই লিংকে সরাসরি ক্লিক করেও দেখা যেতে পারে সংবাদগুলো- http://www.thedailystar.net/google/search .
এই ১০০টি সংবাদের শেষের দিকের ৪/৫টি বাদে সবগুলোই সরাসরি ইউনিলিভার বাংলাদেশ (কয়েকটি অবশ্য অন্যদেশের শাখারও আছে) সংক্রান্ত সংবাদ। ছাপা হওয়ার তারিখের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ক্রম মেনে সার্চ রেজাল্ট আসেনি। সংবাদগুলো গত কয়েক বছরের র্যান্ডম তারিখে এসেছে। গত তিন চার বছরের প্রতিবেদনই বেশি। তবে দুয়েকটি ২০০৮/০৯/১০ ইত্যাদি সালেরও আছে।
নিশ্চিত করে বলা যায়, ডেইলি স্টারে ২০০৮ সাল বা তার পরে থেকে ইউনিলিভার সংক্রান্ত মাত্র এই ১০০টি সংবাদ ছাপা হয়নি। প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। প্রিন্টেড কপি একটি একটি করে দেখলে হয়তো কয়েকগুণ বেশি সংবাদ মিলবে। তবে আপপতত বিকল্প না থাকায় যাচাই বাছাইয়ের জন্য আমরা সাধারণ নমুনা হিসেবে এই ১০০টি সংবাদকে নিতে পারি।
১০০টি প্রতিবেদনের সব ক’টির শিরোনাম এবং বেশ কয়েকটির ভেতরের কন্টেন্টও পড়েছি। দুই ধরনের সংবাদ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখেছি। প্রথমত, কোম্পানিটির বিভিন্ন ছোটবড় ইভেন্টের প্রেসরিলিজ-নির্ভর সংবাদ। দ্বিতীয়, কোম্পানি বা এটির বিভিন্ন অনুসঙ্গ নিয়ে বিশেষ কভারেজে প্রকাশিত সুনাম-গাওয়া বিশেষ ফিচার, আর্টিকেল এবং কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার।
১০০টি সংবাদের মধ্যে নেতিবাচক বলতে একটি শিরোনাম পাওয়া যায়। এবং সেটি কোনো বিশেষ প্রতিবেদন নয়, বরং একটি ডে-ইভেন্ট টাইপের সংবাদ। তার চেয়েও বড় কথা, এটি ইউনিলিভার বাংলাদেশ সংক্রান্ত নয়।
শিরোনামটি হচ্ছে- EU fines Unilever, P&G for detergent price-fixing.
সুনাম-গাওয়া প্রেসরিলিজ-নির্ভর এবং বিশেষ সংবাদ/সাক্ষাৎকার প্রতিবেদনগুলোর কিছু শিরোনাম তুলে দিচ্ছি--
Unilever funds setting up OT, ICU
Unilever starts tree plantation programme
95,000 schoolkids to get nutritious biscuits
375 students get scholarship from Fair & Lovely Foundation
100 poor families get water purifiers
Unilever stands by Sidr-hit people
Unilever awards employees
Unilever No.1 employer in FMCG: survey
Unilever, third most sought-after employer: LinkedIn study
The most shared advertisement in Asia
Unilever official wins 'CNBC Asia Business Leader of the Year' award
CSR heroes awarded
Business heroes honoured
Unilever Bangladesh's ad wins global award
Dissecting the success of Unilever Bangladesh
Unilever goes from strength to strength
WHERE WOMEN CAN SHINE
Unilever Internship: A winning start to career
একটি পাক্কা ‘পাবলিক রিলেশন্স’ প্রতিষ্ঠানের চিত্র! প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদনের সাথে এক বা একাধিক ছবি রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিবেদন ডেইলি স্টারের সাপলিমেন্টারি ম্যাগাজিনগুলোতে কভার স্টোরি হিসেবেও প্রকাশিত হয়েছে।
স্টারের ওয়েবসাইটে unilever ট্যাগ ক্লিক করলে এই লিংকটি ওপেন হয়-- http://www.thedailystar.net/tags/unilever
এখানে মোট সাতটি সংবাদ দেখা গেছে ১৯ অক্টোবর রাত পর্যন্ত। যার মধ্যে দুটি প্রতিবেদন উপরের ১০০টির মধ্যে পাওয়া যায়। বাকি পাঁচটি বিউটি টিপস বিষয়ক এবং একটি বিদেশী সংবাদ (ইউনিলিভার সংক্রান্ত)।
এই ট্যাগ-এও কোম্পানিটি সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক সংবাদ নেই।
Google এ unilever thedailystar.net লিখে সার্চ দেয়ার পর প্রথম তিন পৃষ্ঠায় যেসব নিউজ আসে তার সবগুলো উপরে বর্ণিত ১০০টির মধ্যেই আছে। চতুর্থ পৃষ্ঠা থেকে সরাসরি স্টারের নিউজ আসে না।
আপাতত অনলাইনে এর বেশি যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই (তবে ভবিষ্যতে নেয়ার চেষ্টা থাকবে!)।
শুধু ডেইলি স্টারের ইউনিলিভার সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোর হালহকিকত দেখলে যে কারো কাছে মনে হতে পারে, এই মাল্টিন্যাশনালটি অত্যন্ত পুতঃপবিত্র এবং জনমানুষের কল্যাণে নিবেদিত একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান! যার কাজ হল মানুষের কল্যাণ করতে করতে তারপর কিছু পয়সা বেঁচে গেলে তা প্রফিট হিসেবে নেয়া!! কোনো কোম্পানির নিজস্ব ‘পাবলিক রিলেশন্স’ বিভাগ বা প্রচারণার জন্য চুক্তিবদ্ধ কোনো থার্ড পার্টিকে দিয়ে ডেইলি স্টারের মতো করে এত সুষ্ঠুভাবে নিজেদের পক্ষে ক্যাম্পেইন করিয়ে নেয়া সম্ভব হতো কিনা কে জানে!
ডেইলি স্টারের দেয়া এই ‘ধারণা’র বিপরীতে এখন দেখা যাক ইউনিলিভার বাংলাদেশ নিয়ে বাংলাদেশি অন্য কয়েকটি পত্রিকায় বিগত দুই বছরে কী ধরনের নেতিবাচক সংবাদ এসেছে? দুই তিনটি উদাহরণ অনলাইন থেকেই দেয়া হল--
১৭ অক্টোবর (২০১৬) বাংলানিউজের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম- “ইউনিলিভারের ৭৩ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি, তদন্তে কাস্টমস”।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
ইউনিলিভারের আমদানি করা ৩২টি চালানে ফাঁকি দেওয়া প্রায় ৭৩ কোটি টাকা উদ্ধারে মাঠে নেমেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। প্রকৃত আমদানি পণ্যের নাম পাল্টিয়ে কম শুল্কের পণ্য দেখিয়ে বন্দর থেকে খালাস নিয়ে বিপুল পরিমান এ শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয়।এর একদিন আগে ১৬ অক্টোবর বাংলানিউজের আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম- “গ্রাহকের পকেট কাটছে ইউনিলিভার”
২০১০ ও ২০১১ সালে আমদানি করা চালানে এ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। এরপর ২০১২ সালে একই কায়দায় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা চারটি চালানের মধ্যে দুটি চালান খালাস নিয়ে যাওয়ার পর রাজস্ব ফাঁকির বিষয়টি ধরা পড়ে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়-
দেশি বাজারে চা সংকটের আশঙ্কার কথা বলে প্যাকেটজাত ৪০০ গ্রাম তাজা চায়ের মূল্য ২০ টাকা বাড়িয়েছিল ইউনিলিভার বাংলাদেশ। তবে এখনো পর্যন্ত খোলা বাজারে চায়ের দাম বাড়েনি।২০১৪ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক যুগান্তরের “সম্মানীরাই আত্মসাৎ করেছে ১০ হাজার কোটি টাকা” শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়--
এই একটি পণ্যেই প্রতিদিন সাধারণ মানুষের শত কোটি টাকা নীরবে হাতিয়ে নিচ্ছে ইউনিলিভার। কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই কিছুদিন পর পর বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। এভাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিটি।
রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত অন্যতম আরও বহুজাতিক কোম্পানির মধ্যে রয়েছে সাবান প্রস্তুতকারী বহুজাতিক ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেড ৪৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ২২ কোটি টাকা, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট (বাংলাদেশ) লিমিটেড ১২২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, বাটা স্যু কোং বাংলাদেশ ৩৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা, এসিআই লিমিটেড ৩৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, হোলসিম বিডি লিমিটেড ১৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, নেসলে বাংলাদেশ লিমিটেড ৩ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, সানোফি এভেন্টিস (বাংলাদেশ) লিমিটেড ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা।অর্থাৎ, এখানে উল্লিখিত মাল্টিন্যাশনালগুলোর মধ্যে রাজস্ব ফাঁকিতে ইউনিলিভার বাংলাদেশ শীর্ষস্থানে আছে!
বাংলানিউজের প্রতিবেদনের সত্য-মিথ্যা নিয়ে অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন। তবে যুগান্তরের রিপোর্টের ক্ষেত্রে এটা বলা যায়, যেহেতু এই পত্রিকার বিরুদ্ধে গত দু্ই বছরেও এই প্রতিবেদনের কারণে কোনো মামলা দায়ের করেনি ইউনিলিভার, ফলে রাজস্ব ফাঁকির তথ্যের সত্যতা প্রশ্নাতীত।
আপাতত এটুকুই থাকুক। এখন শুধু ইউনিলিভার এর অন্যান্য দেশীয় কিছু অপকর্মের খতিয়ান দিয়ে রাখা যায়।
1. Unilever: Corporate Crimes (Corporate Watch)
2. Unilever To Pay $4.5 Million for Environmental Crimes
3. Unilever’s alleged crimes in India made public thanks to Nicki Minaj-inspired rap song (New York Times)
4. Unilever accused over rainforest destruction (The Telegraph)
5. SHOCKING HISTORY: UNILEVER EXPOSED
এত কিছু দেখার পর এ পর্যায়ে এসে মনে হল--
এক. ইউনিলিভার কোনো পুতঃপবিত্র কোম্পানি নয়। বাংলাদেশেই তার বিরুদ্ধে রাজস্ব ফাঁকি, বিনা কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি , ঘোষণা দিয়েও প্লাস্টিক কণা পণ্যে মেশানোর মাধ্যমে মানুষের ও পরিবেশের ক্ষতি করা ইত্যাদি গুরুত্বর অপরাধের অভিযোগ ও প্রমাণ আছে। এসব বহু বছর ধরে করে যাচ্ছে কোম্পানিটি।
দুই. কিন্তু ডেইলি স্টারের র্যান্ডমলি খুঁজে পাওয়া ১০০টির বেশি সংবাদের মধ্যে সেসব অপরাধের কোনো নাম-গন্ধও নেই। আছে শুধু সুনাম আর সুনাম। কোথায় কী ধরনের সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করছে, কোথায় করপোরেট রেসপন্সিবিলিটি পালন করছে তার খবর। ঝমকালো উপস্থানায় ইতিবাচক যাবতীয় খবর (বেশিরভাগই সরবরাহকৃত প্রেসরিলিজ নির্ভর)।
তিন. এমন অবস্থায় ডেইলি স্টারে প্লাস্টিক কণা নিয়ে করা প্রতিবেদনে ইউনিলিভারের শঠতা ধরিয়ে দেয়ার আশা করা ঠিক হয়নি আমার! এবং এটাও মনে করা ভুল হয়েছে যে, তথ্যের অভাবে এই শঠতা ধরিয়ে দিতে পারেনি পত্রিকাটি। বরং বণিক বার্তার মতো ইউনিলিভারের আন্তর্জাতিক ঘোষণাটি সম্পর্কে অবগত থাকলেও (ধরে নেয়া যায় অবগত ছিল) ডেইলি স্টার কোম্পানিটির শঠতা ধরিয়ে দিত না।
বাঙালি সংস্কৃতিতে ভাসুর হলেন স্বামীর বড় ভাই। তিনি বিনা প্রশ্নে সম্মান পাওয়ার মতো একজন ব্যক্তি বলে মনে করা হয়। তার ভুলশদ্ধ-অপরাধের কোনো বালাই নেই। সর্ব সময়ে নমস্য তিনি! এমন নমস্য যে, অসম্মান হবার শংকায় তার নাম মুখে নিতেও মানা আছে! ভাসুরের কোনো খারাপ তো দূরের কথা, ভাল কিছুর বর্ণনায়ও নাম মুখে নেয়া যাবে না।
আধুনিক সময়ে ‘সাংবাদিকতার ব্যবসায়’ও ভাসুর সংস্কৃতি খুবই জোরালোভাবে হাজির। এখানে ভাসুর হলেন মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলো। তারা মিডিয়ার ভাসুর। বাঙালি ভাসুরের সাথে করপোরেট ভাসুরের পার্থক্য হচ্ছে, পরের ভাসুরের সুনাম করার সময় নাম মুখে নিয়ে ঢোল বাজিয়ে সবাইকে শোনানে যাবে। কিন্তু দুর্নামের কিছু হলে আর ভাসুরের নাম মুখে নেয়া যাবে না!
ডেইলি স্টার ‘সাংবাদিকতার ব্যবসা’র এই সংস্কৃতির ইজ্জত রেখেছে এবং রাখছে। তার অন্যতম ভাসুর ইউনিলিভারের নাম মুখে নিয়ে কোনো বদনাম করেনি এবং আশা করা যায় করবেও না। সেটা প্লাস্টিক কণা সংক্রান্ত সংবাদের ক্ষেত্রে হোক আর অন্যক্ষেত্রেই হোক।
আলোচ্য ভাসুরের সাথে স্টারের যে ধরনের সম্পর্ক উপরে চিত্রিত হয়েছে সেটাকে কেউ ‘আপত্তিকর’ বলে অভিযোগ করলেও করতে পারেন। কিন্তু তাকে মনে রাখতে হবে, এর কারণে পত্রিকাটির ‘নীতিনৈতিকতাপূর্ণ সাংবাদিকতা’ মার খেয়ে যাবে না!
তথ্যবহুল লেখা। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার ধান্দাবাজি বুঝতে আজকাল আর বোদ্ধা হতে হয় না।
উত্তরমুছুনযতদূর জানি হরলিক্স গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) এর প্রোডাক্ট। ইউনিলিভার এর না। এইটা কারেকশন দিয়েন।
ধন্যবাদ। কারেকশন দিয়েছি। এই নিউজটাতে ফেয়ার এন্ড লাভলি সেকন্ড-বেস্ট ব্রান্ড হয়েছে সেই খবর আছে। তবে এই লেখার ক্ষেত্রে শিরোনামে হরলিক্স থাকা মিসলিডিং হওয়ায় এই শিরোনামটি বাদ দিলা।
উত্তরমুছুনতথ্যবহুল লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন