সোমবার, জুন ১৩, ২০১৬

‘বুদ্ধিজীবী’ ও ‘বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী’র মৃত্যুসংবাদ লেখার কৌশল


কদরুদ্দীন শিশির

পড়ছিলাম বিডিনিউজের খবরটি-- “অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা আর নেই”

খবর শুরু হল এভাবে--

“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।


বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী মনিরুজ্জামান মিঞা অসুস্থতার কারণে অনেকদিন ধরেই অনেকটা আড়ালে ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

মনিরুজ্জামান মিঞা বিএনপি সমর্থক পেশাজীবীদের সংগঠন শত নাগরিক জাতীয় কমিটির সদস্য ও জিয়া পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় পুনর্গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনে অধ্যাপক মনিরুজ্জামানকে কমিশনারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।”
//

এ পর্যন্ত পড়ে পাঠক হিসেবে জানতে পারলাম, ঢাবির উপাচার্য হওয়ার পাশাপাশি মনিরুজ্জামানের আর যে পরিচয়টি খবরে উল্লেখ করার মতো তা হলো, তিনি ‘বুদ্ধিজীবী’ ছিলেন না, ‘বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী’ ছিলেন।

মরার আগ পর্যন্ত এই লোক ‘শুধু বিএনপির হয়েই’ কাজ করে গেছেন। বিএনপির বাইরের মানুষজনের জন্য কিছুই করেননি। ফলে তিনি নির্দিষ্টভাবে বিএনপির বুদ্ধিজীবী। যদি তিনি জীবনে একটা কাজও বিএনপির বাইরের কারো জন্য করতেন, তাহলে ‘শুধু বুদ্ধিজীবী’ হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু করেননি, এটা তার দোষ।

প্রায়ই পত্রিকার পাতায়/অনলাইন পোর্টালে বড় ছোট নানা মানুষের মৃত্যুসংবাদ পড়ি। ওইসবে দেখেছি, ‘মারা যাওয়া’ ‘স্থান কাল’ ‘বয়স’ ‘মৃত্যুর কারণ’ সংবাদের ইন্ট্রোতে ইত্যাদি তথ্য উল্লেখ করার পর মৃতের পরিবারের কারো, বা হাসপাতালে মারা গেলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। রোগ বালাই কী ছিল, কবে ভর্তি হলেন হাসপাতালে ইত্যাদি তথ্য জানান তারা।

এরপরই গুরুত্ব দেয়া হয় মৃতের জানাযা-দাফন সংক্রান্ত তথ্যগুলো।

মৃত্যুর ঘটনার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত এসব তথ্য-বক্তব্য দেয়ার পর আসে মৃতের জীবন ও কর্ম সংক্রান্ত বিবরণ। বড় ব্যক্তি হলে অনেক অনেক কথাবার্তা, তথ্য আসতে পারে এ বিষয়ে।

মৃত্যুসংবাদে মৃতের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য সাধারণত কেমন ক্রমানুসারে দেয়া হয়ে থাকে তা সহজে বুঝতে দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন থেকে মনিরুজ্জামানেরই মৃত্যুসংবাদের পুরো টেক্সটের স্ক্রীনশটটি দেয়া হল--

প্রথম আলোর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মনিরুজ্জামান মিঞা আর নেই’
(প্রথম আলোও অবশ্য মনিরুজ্জামানকে ‘বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে এই তথ্যটি প্রথম আলো সংবাদের ‘যে জায়গায়’ দিয়েছে তা স্বাভাবিক চর্চার অংশ। সংবাদের ইন্ট্রোতে বা ইন্ট্রোর পরে নিয়ে যায়নি।)

এবার উপরে বিডিনিউজের খবরের যে প্রথম চারটি প্যারা উদ্ধৃত করা হয়েছে সেগুলোর দিকে চোখ দিন। ইন্ট্রোতেই (প্রথম দুই প্যারা) মৃতকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে- ‘বিএনপিপন্থি বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে। এবং তারপরের দুটি প্যারাতে মৃত্যু সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় অন্যান্য তথ্য না দিয়ে এক দৌড়ে মৃতের ‘জীবন ও কর্ম’তে চলে গেছেন রিপোর্টার। আবার ‘জীবন ও কর্ম’ হাইলাইট করার ক্ষেত্রে মূল ফোকাস হচ্ছে মৃতকে একটি রাজনৈতিক পক্ষে (সরকারবিরোধী) ঠেলে দেয়া।

খবরের পঞ্চম প্যারাটি এরকম--

“বিএনপি জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ (সোমবার) বেলা ১২টার দিকে তার মৃত্যু হয়।”

মৃতের ‘রাজনৈতিক পক্ষ’ এর বিষয়ে বিডিনিউজ যে তথ্যটি প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছে সেটিকে আরো জোরালো করতে এখানে রীতিবিরুদ্ধভাবে মৃতের পরিবারের কারো বা চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট কারো কাছ থেকে বক্তব্য না নিয়ে বিএনপি-মুখপত্রের দ্বারস্ত হয়েছে পত্রিকাটি!

রিজভীর মুখ দিয়ে যে দু/তিনটি তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলো মূলত মনিরুজ্জামানের কোনো চিকিৎসকের বক্তব্য হলেই বেশি সঙ্গত হত। অথবা পরিবারের কোনো সদেস্যেরও হতো পারতো।

এরপরের প্যারাগুলোতে ‘জীবন ও কর্ম’ বর্ণনা করে গেছে বিডিনিউজ। দিয়েছে বিএনপির শোক প্রকাশের তথ্য।

এবং সব শেষ প্যারায় দাফন-জানাযা নিয়ে তথ্য দেয়া হয়েছে।

এখন প্রশ্ন করা যায়, ‘বিডিনিউজ কি সব রাজনৈতিক দলের সাথে ঘনিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যুসংবাদ লেখার ক্ষেত্রে একই রকম ফরমেট অনুসর করে?” উত্তর পাওয়া যাবে কিছুদিন আগে মৃত্যুবরণ করা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের খুবই ঘনিষ্ঠ একজন সিনিয়র সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে লেখা মৃত্যুসংবাদটি খেয়াল করলে।

(এই সংবাদটি গুগলে র‌্যান্ডম সার্চে সহজে পাওয়া গেছে বলে তুলনার জন্য নেয়া হয়েছে। অন্য আওয়ামীপন্থী কোনো বুদ্ধিজীবীর মৃত্যুসংবাদ পেলে সেগুলোও দেখলে আরো ভালভাবে বিষয়টি যাচাই করা যেত)

সংবাদটি হচ্ছে--

“সাংবাদিক আলতাফ মাহমুদ আর নেই”

খবরটির ইন্ট্রো থেকে পর পর কয়েকটি প্যারা তুলে দিচ্ছি--

“বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি আলতাফ মাহমুদ আর নেই।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার সকাল ৮টা ৪০ মিনিটে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।

বিএসএমএমইউ’র উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অস্ত্রোপচারের পর তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়েছিল। গত রাতে হঠাৎ শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে যায়। আজ সকালে তার লাইফ সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।”

সাংবাদিক আলতাফ মাহমুদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দৈনিক ডেস্টিনির নির্বাহী সম্পাদক আলতাফ মাহমুদ ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন। স্পাইনাল কর্ডে সমস্যার কারণে তার দুই পা অবশ হওয়া ছাড়াও দুই হাতেও শক্তি পাচ্ছিলেন না।

স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কনক কান্তি বড়ুয়ার নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি দল বৃহস্পতিবার দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর বলেছিলেন, তারা আশাবাদী।”
//

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন দুইভাবে বিভক্ত। তাদের স্পষ্ট পরিচয়-- একপক্ষ আওয়ামীপন্থী, অন্যপক্ষ বিএনপিপন্থী।
আলতাফ মাহমুদ আওয়ামীপন্থী অংশের সভাপতি থাকাবস্থায়ই মারা গেছেন।

বিডিনিউজ খবরের ইন্ট্রোতে (প্রথম দুই প্যারা) ‘একাংশের সভাপতি’ বললেও আওয়ামী অংশ কিনা- উল্লেখ করেনি। অর্থাৎ, আলতাফ আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক বা ‘বুদ্ধিজীবী’ কিনা- তা হাইলাইট করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি পত্রিকাটি। যেমনটি  মনিরুজ্জামান মিয়াকে ‘বিএনপিন্থীপন্থী বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে পরিচয়ের প্রয়োজন হয়েছে!

উপরেই বলেছি, ইন্ট্রোর পরেই সাধারণত মৃত্যুর কারণ ইত্যাদি নিয়ে চিকিৎসকের বা পরিবারের কারো বক্তব্য থাকাই নিয়ম বা রীতি। আলতাফ মাহমুদের মৃত্যুসংবাদের ক্ষেত্রে এটা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। বিএসএমএমইউ’র (পিজি হাসপাতাল) উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান এর মুখ দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রকাশ করেছে বিডিনিউজ। অন্যদিকে মনিরুজ্জামানের ক্ষেত্রে পত্রিকাটি একই রকমের তথ্যের জন্য দ্বারস্ত হয়েছিল রাজনৈতিক দল বিএনপির মুখপাত্র রিজভীর!

শোক প্রকাশের তথ্যের ক্ষেত্রেও একটা রাখঢাক আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে আওয়ামী লীগের, মানে আলতাফ মাহমুদ যে দলের প্রতি আনুগত্যশীল, সভানেত্রীও। কিন্তু সংবাদে শুধু তার ‘প্রধানমন্ত্রী’ পরিচয়টি ব্যবহার করা হয়েছে। ‘আওয়ামী লীগ’ সভানেত্রী নয়।

আরো লক্ষ্যণীয়, আলতাফ মাহমুদ সংক্রান্ত সংবাদটির পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম প্যারা পর্যন্ত মৃতের ‘জীবন ও কর্ম’ (আওয়ামী জীবন ও কর্ম) নিয়ে ব্যস্ত হয়নি, যেমনটি মনিরুজ্জামানের ‘বিএনপিয় জীবন ও কর্ম’ নিয়ে ব্যস্ত হয়েছিল তৃতীয় প্যারা থেকেই।

সর্বশেষ অষ্টম ও নবম প্যারা দুটিতে আওয়ামী লীগের প্রতি আলতাফ মাহমুদের চুড়ান্ত ভালবাসা ও আনুগ্যতের প্রমাণ ফুটে উঠলেও সেখানেও তাকে ‘আওয়ামীপন্থী’ বলে তাকে রাজনৈতিক পক্ষে ঠেলে দেয়নি বিডিনিউজ।

আমি এই লেখাটির যে শিরোনাম দিয়েছি, সেটিতে ‘মৃত্যুসংবাদ’ লেখার যে ‘কৌশল’ এ কথা বলা হয়েছে- সেই কৌশল আমি আলাদা করে বাতলে দিচ্ছি না। বিডিনিউজ যে কৌশলে ‘আওয়ামীপন্থী বুদ্ধিজীবী’কে ‘বুদ্ধিজীবী’ এবং ‘অ-আওয়ামী বুদ্ধিজীবী’কে ‘বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের মৃত্যুসংবাদ লিখে থাকে, যা এখানে দেখানো হয়েছে- সেখান থেকে আপনারা আশা করি শিখে নিতে পারবেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন