কদরুদ্দীন শিশির
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় দুটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হল গত ১৯ মে। তাতে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরেছেন মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। আর আসামে ইতিহাস গড়ে প্রথমবারের মতো বিজয়ী হয়েছে ভারতের কেন্দ্রী ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।
অবশ্য একইসাথে আরো তিনটি রাজ্যেও নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে উল্লিখিত দুটি রাজ্যের ফলাফল বাংলাদেশের স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় এ নিয়ে বাংলাদেশে বেশি আলাপ-আলোচনা হওয়া স্বাভাবিক।
১৯ মে ফলাফল ঘোষণার পর ২০ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত ৫ দিনের মধ্যে ৪দিন ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মুদ্রিত কপি বের হয়েছে। এসব পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এবং সর্বানন্দ সানোয়ালের নেতৃত্বে বিজেপি বিজয়কে এই চারদিনের সংবাদ ও মতামতে কী ধরনের কভারেজ দেয়া হয়েছে আমরা তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে যাচাই করে দেখবো।
এ জন্য মূলত ঢাকার উল্লেখযোগ্য পাঁচটি পত্রিকাকে বাছাই করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- প্রথম আলো, সমকাল, কালের কণ্ঠ, ইত্তেফাক ও ডেইলি স্টার। সাথে এক নজর দেখে নেব উল্লেখযোগ্য অনলাইন সংবাদমাধ্যম বাংলানিউজ, বিডিনিউজ এবং বাংলাট্রিবিউনের এ সংক্রান্ত কয়েকটি শিরোনামও।
তার আগে বলে রাখা ভাল, পশ্চিমবঙ্গে মমতার পূঃনির্বাচিত হওয়ার সাথে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের একটা যোগসূত্র রয়েছে। তার জয় তিস্তা চুক্তির জন্য ইতিবাচক বলে বাংলাদেশ সরকারের এবং এখানকার বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এটা বাস্তব হলে পশ্চিবঙ্গের ফলাফলে বাংলাদেশের কিছুটা উচ্ছসিত হবার কারণ আছে। যদিও অনেকে মনে করেন, মমতার বিপুল বিজয় তিস্তাকে আরো হুমকিতে ফেলল! (এই মতের বিষয়ে লেখার একদম শেষে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে)।
অন্যদিকে আসামের নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হয়েছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার সর্বাগ্রে ছিল রাজ্যটি থেকে কথিত ‘বাংলাদেশি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের’ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। এটি বাস্তবায়ন দুই বছরের মধ্যে হবে বলে হবু মুখ্যমন্ত্রী সানোয়াল ফলাফলের আগে পরে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে আসামের নির্বাচনী ফলাফল বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই উদ্বেগজনক।
ঢাকার পত্রিকাগুলো মমতা ব্যানার্জির বিজয় নিয়ে যারপরনাই উচ্ছসিত ছিল। এটা সংবাদের ট্রিটমেন্ট এবং ভাষা থেকে স্পষ্ট। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যায় যেমন- দৈনিক ইত্তেফাক ২০ মে তাদের প্রধান শিরোনাম করেছে ‘দোর্দণ্ড প্রতাপে বহাল মমতা’। পাশে মমতার বড় ছবি। এদিন এটিসহ ভারতের পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন নিয়ে প্রথম ও ভেতরের একাধিক পাতায় সর্বমোট ১০টি সংবাদ ছাপিয়েছে ইত্তেফাক।
কালের কণ্ঠের প্রথম পাতায় ডাবল কলামে উচ্ছসিত শিরোনাম ‘মমতা-ঝড়ে জোট তছনছ’। প্রতিবেদনটির ইন্ট্রো ছিল এরকম ‘সাড়ম্বরে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করতে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮ জেলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে কার্যত ‘সবুজ বিপ্লব’ (দলীয় প্রতীক ঘাসফুলের রং) ঘটিয়ে ৪৯ বছর পর বিধানসভায় একক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিপুলসংখ্যক আসনে জয় পাওয়ার রেকর্ড গড়ল মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেস।’ এখানেও উচ্ছাস! সমকালের প্রথম পাতায় ৩ কলামে বক্স আইটেম ছিল ‘আবার মমতা’।
কিন্তু আসামে বিজেপির জয় নিয়ে কোনো উদ্বেগ পরিলিক্ষিত হয়নি সংবাদের ট্রিটমেন্ট এবং ভাষায়। যেমন মমতাকে নিয়ে বড় শিরোনামের নিচে সিঙ্গেল শিরোনাম ‘আসামে বিজেপি কেরালায় বাম’। কালের কণ্ঠেও সিঙ্গেল কলাম ‘আসামে বিজেপি কেরলায় বাম’। ইত্তেফাকের সিঙ্গেল কলাম ‘আসামে বিজেপি কেরালায় বাম তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার জয়’। সবগুলোই একদম সাদামাঠা ফলাফল নির্ভর সংবাদ। এর মধ্যে ইত্তেফাক ‘বাংলাদেশ-আসাম সীমান্ত বন্ধ করা হবে’ শিরোনামে সর্বানন্দ সানোয়ালের বক্তব্যকে ১৯তম পৃষ্ঠায় সিঙ্গেল কলামে আলাদাভাবে ছাপিয়েছে। সমকাল ও কালের কন্ঠ এটা নিয়ে আলাদা প্রতিবেদন করেনি।
পরবর্তী দিনগুলোতেও এ তিনটি পত্রিকার একই অবস্থা। মমতার জয় নিয়ে উচ্ছাসভরা প্রতিবেদন আছে, কিন্তু আসামে বিজেপির জয় নিয়ে কোনো ‘উদ্বেগ’ ফুটে উঠা প্রতিবেদন নেই। ২১ মে ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ডাবল কলাম শিরোনাম ‘কোনো অপপ্রচারই থামাতে পারেনি মমতার জয়রথ’ এবং সিঙ্গেল কলামে ‘মমতার শপথে জমবে তারার মেলা’।
সংবাদ প্রতিবেদনের বাইরে পত্রিকাগুলো মতামত কলামেও একইরকম চিত্র।
কালের কণ্ঠের উপসম্পাদকীয়তে রাজ্যের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন জয় করেও ভয়’ শীর্ষক একটি লেখা এবং ২৪ মে এরকম আরেকটি লেখা ছাপা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের ফলাফলের সাথে বাংলাদেশের লাভক্ষতি কী, তা নিয়ে কোনো লেখা ছিল না। ইত্তেফাকেও কোনো উপসম্পাদকীয় নেই। তবে সমকাল ২১ তারিখ ‘আসামে বিজেপির বিজয় ও সম্ভাব্য শঙ্কা’ এবং ২২ তারিখ ‘ভারতের রাজ্য নির্বাচনের ফল ও বাংলাদেশ’ শিরোনামে দুটি উপসম্পাদকীয় ছাপিয়েছে।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ২১ মে’র কভারেজে কিছুটা মিল রয়েছে। পত্রিকা দুটি মমতাকে নিয়ে উচ্ছাসের চেয়ে ভারতের সার্বিক রাজনীতিতে ফলাফলে প্রভাবকে প্রাধান্য দিয়ে মূল প্রতিবেদনগুলো করেছে। প্রথম আলোর শিরোনাম ‘স্বস্তিতে মোদি, বেহাল কংগ্রেস’ আর ডেইলি স্টারের মূল প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘BJP widens sway in India’ বা ভারতে ক্ষমতা প্রভাব বাড়ালো বিজেপি। একই সাথে একটি ‘সংবাদ বিশ্লেষণ’ ছাপিয়েছে ‘New BJP wave sinks Congress: Results in Assam may have impact on Bangladesh’ বা ‘বিজেপি নতুন জোয়ারে ডুবলো কংগ্রেস: আসামের ফলাফল বাংলাদেশের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে’।
প্রথম আলোর ‘স্বস্তিতে মোদি, বেহাল কংগ্রেস’ শিরোনামের খবরটির ভেতরেই আসাম প্রসঙ্গে বাংলাদেশের উদ্বেগটা কী সে বিষয়ে কিছুটা ধারণা দেয়া হয়েছে। যদিও এ নিয়ে আলাদা প্রতিবেদন ছাপায়নি। অবশ্য মমতাকে নিয়ে প্রথম পাতায়ই ডাবল কলাম ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ মমতারই’।
২২ মে ডেইলি স্টার কোনো নতুন প্রতিবেদন না ছাপালেও উপসম্পাকীয়তে ‘Assam Election Results: What does it mean for Bangladesh?’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপিয়েছে। অন্যদিকে, প্রথম আলো আসাম ইস্যুকে হাইলাইট করে ২১ তারিখ দিল্লীতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলীর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি বিশেষ প্রতিবেদন ছাপিয়েছে ডাবল কলামে। এছাড়া ২২ তারিখ উপসম্পাদকীয়তে ‘আসামে বিজেপির জয় ও বাংলাদেশের উদ্বেগ’ শীর্ষক একটি লেখা এবং ২৪ তারিখে ‘আসামের ‘অনুপ্রবেশ’ সমস্যা দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে’ শিরোনামে বিশেষজ্ঞদের মতামত ভিত্তিক একটি প্রতিবেদন ছাপিয়েছে প্রথম পাতায়। এই প্রতিবেদনে মমতার বিজয়কে তিস্তা চুক্তির জন্য ইতিবাচক বলা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি আসাম ইস্যুতে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার মোটামুটি সরব ছিল অন্য তিনটি পত্রিকার তুলনায়।
এখন উল্লেখযোগ্য কয়েকটি অনলাইন সংবাদমাধ্যমের কয়েকটি উচ্ছসিত শিরোনাম শুধু তুলে দেব। বিডিনিউজ: ‘বিপুল বিক্রমে বহাল মমতা’, ‘মমতা-জয়ললিতায় আস্থা, আসামে উত্থান বিজেপির’। বাংলানিউজ: ‘আবার মমতার হাতেই বাংলা!’, ‘তামিলে ফের আম্মা, আসামে ফুটছে পদ্ম!’, ‘কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসন হটিয়ে আসামেও আসছে বিজেপি!’ এসবের পাশে বাংলাটিবিউনের একটি ‘বেমানান’ শিরোনাম ‘যে কারণে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের ফল ঢাকার জন্য সুখবর নয়’। দিল্লীতে রঞ্জন বসুর লেখা এই প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে, ‘....(বিপুল আসনে জয়লাভ করায়) সোজা কথায় দিল্লিতে তৃণমূল কংগ্রেসের দরকষাকষির ক্ষমতা কমার বদলে বাড়লো। এ বাস্তবতারই সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে তিস্তা চুক্তির ওপর।... সে ক্ষেত্রে অবধারিতভাবেই তিস্তা চুক্তির ভাগ্য নিয়ে নতুন করে সংশয় তৈরি হবে।’
তিস্তা নিয়ে সংশয় তৈরি হলেই বা কী! এখানকার পত্রিকাগুলোর উচ্ছাসে কোনো ভাটা তো পড়ছেনা। আর ‘বাঁধভাঙা’ এই উচ্ছাসে ভেসে যাচ্ছে আসাম ঘিরে বেড়ে উঠা উদ্বেগটাও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন