কদরুদ্দীন শিশির
২৭ মে বিবিসি বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, “সজীব ওয়াজেদের সাথে `বৈঠক` হয়েছে: সাফাদি”। তার আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জাহিদ এফ সরদার সাদী নামে এক বাংলাদেশি সাংবাদিক (যিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও আপলোড করেন।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন এবং জনাব সাদীর ভিডিও দুটোই বাংলাদেশে সম্প্রতি আলোচিত ইসরাইলি রাজনীতিক এবং শেখ হাসিনা সরকারের প্রচারণা মতে ‘মোসাদ এজেন্ট’ মেন্দি এন সাফাদির দুটি আলাদা সাক্ষাৎকার। উভয় সাক্ষাৎকারে সাফাদি জানিয়েছেন, (তার সাথে সাক্ষাতের অপরাধে) বর্তমানে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কারাগারে আটক বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সাথে ভারতে সাক্ষাৎ করার আগে তার (সাফাদি) সাথে সজীব ওয়াজেদ জয় নামে আরেক বাংলাদেশি নাগরিক দেখা করেছেন।
বিবিসির প্রতিবেদন থেকে--
“বাংলাদেশে সরকার উৎখাত ষড়যন্ত্রের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা ইসরাইলের ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির নেতা মেন্দি এন. সাফাদি দাবি করেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও তার তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের সঙ্গে গত বছর তার সাক্ষাৎ হয়েছিল।
বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় অভিযুক্ত বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সাথে দিল্লিতে তার দেখা হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মি. ওয়াজেদের দপ্তরে দুজনের কথাবার্তা হয়।”
সজীব ওয়াজেদের সাথে কী কথা হয়েছে তাও বিবিসিকে জানিয়েছেন সাফাদি--
“মি. সাফাদি জানান, বৈঠকে সজীব ওয়াজেদই মূলত কথা বলেন। তিনি শুধু শোনেন। এসময় মি. ওয়াজেদ তার কাছে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন যে বাংলাদেশের সরকার কত ভাল কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্কে কত ভাল।
মি. সাফাদি দাবি করেন যে সারা বিশ্বে তার ব্যক্তিগত যোগাযোগের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মি. ওয়াজেদ সরকারের পক্ষে সমর্থন বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তিনি বলেন, মি.ওয়াজেদের বক্তব্যের সাথে তিনি একমত হতে পারছেন না।
তিনি তাকে বলেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের হত্যার খবর দেখতে পাচ্ছেন। মি. ওয়াজেদ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এ খবরগুলো ভুল। সব মিলিয়ে বৈঠকটির স্থায়িত্ব ১৫ থেকে ১৬ মিনিটের বেশি ছিল না বলে মি. সাফাদি বিবিসিকে জানান।”
হট ইস্যু:
গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেন্দি এন সাফাদি এক রহস্যপুরুষে পরিণত হয়েছেন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় অজানা গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে আসলাম চৌধুরীর সাথে মেন্দি এন সাফাদির বৈঠকের খবর প্রচারিত হয়। প্রতিবেদনগুলোতে দাবি করা হয়, আসলাম ‘মোসাদ এজেন্ট’ সাফাদির সাথে মিলে শেখ হাসিনা সরকারকে ভারতে বসে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে।
এসব সংবাদের ভিত্তিতে ১৫ মে সরকার আসলামকে গ্রেফতার করে। এবং ২৬ মে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে।
এই ইস্যুতে ইতোমধ্যে কোণঠাসা হয়ে থাকা বিরোধী দল বিএনপি আরো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। রিমান্ডে আসলাম সব সড়যন্ত্রের কথা স্বীকার করে বিএনপি এবং জোটের আরো বেশ কয়েকজন নেতার সংশ্লিষ্ট থাকার তথ্য জানিয়েছেন- এমন প্রতিবেদন ১৫ মে’র পর থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন পত্রিকায় বিশাল কভারেজে ছাপা হয়েছে। সরকারের মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাফাদি ইস্যুতে বিএনপির সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছেন এবং এমন ষড়যন্ত্রের পরিণত ভাল হবে না বলে তারা নিয়েমিত হুশিয়ারি দিচ্ছেন।
আসলমা এবং সাফাদির সাক্ষাৎ, যেটি মুক্ত থাকাবস্থায় আসলামের এবং সাফাদির দাবি অনুযায়ী স্রেফ একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ ছিল, ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবং যে অনুষ্ঠানকে উপলক্ষ্য করে সাক্ষাৎ হয় সেটির আয়োজক হাসিনা সরকারের প্রধানতম সমর্থক ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির যুবসংগঠন হওয়ায়, সেই সংগঠনের পক্ষ থেকে আসলামের গ্রেফতারে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়। (বিবিসির প্রতিবেদন) একই সাথে সাফাদির সাথে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগকেও তারা উড়িয়ে দেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি তোলপাড় করা সাফাদি ইস্যু ভারত পর্যন্ত পৌঁছানোয় এ ঘটনার গুরুত্ব আরো বেড়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন প্রতিটি মানুষ এই ইস্যুতে খুবই সতর্কতার সঙ্গে ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে থাকবেন এটিই স্বাভাবিক।
ফলে সাফাদিকে নিয়ে নতুন ধরনের তথ্য বা বক্তব্য এই মুহুর্তে বাংলাদেশে ‘হট ইস্যু’র মর্যাদা পাচ্ছে। সাংবাদিকতার সাধারণ জ্ঞান সম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তি এটি স্বীকার করতে বাধ্য।
কিন্তু কী আশ্চর্য্য! এই ‘হট ইস্যু’টিকে একেবারে ব্লাকআউট করে দিল বাংলাদেশের মিডিয়া!
(‘মিডিয়া’ এখানে পত্রিকা ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম অর্থে। কারণ টিভি চ্যানেলগুলোর রিভিউ এখানে করা হয়নি।)
২৬ মে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাদীর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এবং ২৭ মে বিবিসি বাংলার মতো বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে ‘মর্যাদাবান’ বলে বিবেচিত নিউজ আউটলেটে সাফাদির বক্তব্য প্রচারিত হওয়ার পর আমি ২৮ মে এর জাতীয় পত্রিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১০টিকে বেছে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। তাতে দেখা গেছে, মাত্র একটি পত্রিকা ছাড়া বাকি নয়টিতে সজীব ওয়াজেদের সাথে সাক্ষাৎ হওয়া নিয়ে সাফাদির বক্তব্যের উপর কোনো প্রতিবেদন ছাপা হয়নি!
পর্যবেক্ষণকৃত পত্রিকাগুলো হচ্ছে, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ইনকিলাব, কালের কণ্ঠ, সমকাল, ইত্তেফাক, যুগান্তর, জনকণ্ঠ, এবং বাংলাদেশ প্রতিদিন।
একমাত্র দৈনিক ইনকিলাব সাফাদির বক্তব্য ছাপিয়েছে। তবে সেটা করতে পত্রিকাটিকে ‘কৌশলের’ আশ্রয় নিতে হয়েছে। ২৭ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সাথে সাফাদি-আসলাম ইস্যুতে কথা বলার সময় প্রশ্নের জবাবে জয়ের সাথে বৈঠকের বিষয়ে কিছু কথা বলেন। সেই কথার সূত্র ধরে সাফাদির বক্তব্যটা তুলে ধরেছে ইনকিলাব। প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামের সংবাদটির শিরোনাম হচ্ছে, “জয়ের সাথে এন সাফাদির বৈঠকের খবর জানা নাই, এটা অপপ্রচার হতে পারে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী”। প্রতিবেদনের নিচের দিকে সাফাদি জয়কে নিয়ে কী বলেছেন তা পুরোটা তুলে ধরলেও ‘জয়ের সাথে বৈঠকের দাবি সাফাদির’ এমন ধরনের কোনো আলাদা প্রতিবেদন ছাপানোর ‘ঝুঁকি’ নিতে চায়নি পত্রিকাটি!
বাকি ৯টি পত্রিকায় জয়কে নিয়ে সাফাদির কোনো বক্তব্য নেই। এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে এটিকে অপপ্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সেই তথ্যটা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি কেউ। কিন্তু এই একই সাফাদি নিয়ে আসলাম সংক্রান্ত নানা তথ্য ঠিক রয়েছে পত্রিকাগুলোতে!
বিশেষ করে দৈনিক যুগান্তরের একটি রিপোর্ট ছিল বেশি লক্ষণীয়। “যমুনা টিভির এক্সক্লুসিভ: সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির কথা স্বীকার সাফাদির” শিরোনামে প্রথম পাতায় একটি সংবাদ ছাপিয়েছে যমুনা গ্রপের মালিকাধীন পত্রিকাটি।
সেখানে লেখা হয়েছে--
“বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টার কথা স্বীকার করেছেন আলোচিত ইসরাইলি নাগরিক মেন্দি এন সাফাদি। যমুনা টেলিভিশনকে দেয়া এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেছেন। নিউইয়র্কে সাফাদির সঙ্গে কথা বলেছেন যমুনা টিভির সাংবাদিক হাসানুজ্জামান সাকী। মেন্দি এন সাফাদির ভাষ্যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই,নির্যাতিত হচ্ছেন সংখ্যালঘুরা। তিনি জানান, বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক হয় ঘটনাক্রমে। তিনবার কথা হয় তাদের।”
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, সরকারপ্রধানের উপদেষ্টার (সজীব জয়) সাথে বৈঠক সংক্রান্ত সাফাদির সাক্ষাৎকারকে ব্লাকআউট করে গেলেও বিএনপি নেতার সাথে সাক্ষাৎকার সংক্রান্ত রিপোর্টটিকে ঠিকই গুরুত্বসহকারে ছাপিয়েছে যুগান্তর!
বাকি ৮টি পত্রিকায় আসলামের সাথে ‘সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে’ আরো অনেকের জড়িত থাকা নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, আসলামের রিমান্ড আবেদন, বিএনপি মূখপাত্র রিজভী এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের এ সংক্রান্ত বক্তব্য ইত্যাদি নিয়ে এক বা একাধিক প্রতিবেদন ছিল। তবে জয়-সাফাদি বৈঠক নিয়ে একটি শব্দও ছিল না। যেন কিছুই ঘটেনি।
(এখানে বলে রাখা ভাল, দেশের অনলাইন সংবাদমাধ্যমের মধ্যে প্রথম সারি বলে স্বীকৃত কোনোটিতেই খবরটি পরিবেশিত হয়নি। দ্বিতীয় সারির কয়েকটিতে অবশ্য দেখা গেছে ভিডিওসহ এই খবরটি।)
বাংলাদেশী মিডিয়ায় ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন সংবাদকে ব্লাকআউট (শতভাগ এড়িয়ে যাওয়া) করার ঘটনা এটি নতুন নয়। বিগত কয়েক বছর ধরে এমনটি মাঝে মাঝেই দেখা গেছে।
দেশে গণমাধ্যমের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে ধরনের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে আছে তাতে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, ‘ভয়ে এড়িয়ে গেছে বোধয়’! এক্ষেত্রে ইনকিলাবের ‘কৌশল’টি একটি উত্তর হতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ ইস্যুতে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা বলেছেন তা কেন পত্রিকাগুলো তুলে ধরেনি? মন্ত্রী ‘অপপ্রচার’ বলেছেন, সেটাই কেন রিপোর্ট করা হয়নি? এটা খুবই অস্বাভাবিক চর্চা। তবে আলোচনায় থাকা ইস্যুতে নতুন মোড় যুক্ত করা তথ্য/বক্তব্য একদম এড়িয়ে যাওয়াও কম অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।
এই অস্বাভাবিক আচরণ শুধু ভয় থেকে হয়নি, সংবাদমাধ্যমের ‘গেটকিপাররা’ নিজেরা ‘স্বাধীনভাবেই’ এমনটি করেছেন। সাংবাদিকতার নীতি লংঘন করে জনস্বার্থে জরুরি তথ্য প্রকাশ করার বিপরীতে সেটিকে লুকিয়ে রাখতে তারা তাদের ‘স্বাধীনতা’কে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশে ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা’ এখন এভাবেই সংজ্ঞায়িত হয়।
নোট: ২৮ তারিখ সাংবাদিকদের প্রশ্নে জবাবে আওয়ামী লীগের মূখপাত্র মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, “জয়-সাফাদি বৈঠকের খবর বিএনপির নাটক: হানিফ”। তার এই বক্তব্যটি প্রথম আলো, বিডিনিউজসহ একাধিক পত্রিকার অনলাইনে দেখা যাচ্ছে।
Bangladeshi print newspapers are dominated by pro-India elements...By last one decades they have transformed to be black propaganda instrument for India's secret service RAW
উত্তরমুছুনসুন্দর মুল্যায়ন।
উত্তরমুছুন