বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২১, ২০১৬

জয়-রেহমান প্রসঙ্গে দুটি রিপোর্ট ও মিডিয়ার পছন্দ-অপছন্দ


দ্য ওয়্যার ও পিটিআই’র দুই প্রতিবেদন


কদরুদ্দীন শিশির


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে যুক্তরাষ্ট্রে কথিত ‘অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা’র অভিযোগে বাংলাদেশে দায়ের করা মামলায় প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের (সাথে সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকেও) ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০ এপ্রিল বিদেশী দুটি সংবাদমাধ্যমে দুটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সংবাদমাধ্যম দুটিই ভারতীয়। প্রথম রিপোর্টটি হচ্ছে ‘দ্য ওয়্যার’ এ প্রকাশিত Exclusive: US Court Dismissed Claim of Plot to Injure Bangladesh PM Son

http://thewire.in/2016/04/20/exclusive-us-court-dismissed-claim-of-plot-to-injure-bangladesh-pm-son-30447/

দ্বিতীয়টি হচ্ছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই এর US helped Bangladesh in uncovering plot to kill Hasina’s son: Official.

http://www.hindustantimes.com/world/us-helped-bangladesh-in-uncovering-plot-to-kill-hasina-s-son-official/story-stZQTItncyKCWzIEW80ioJ.html

প্রকৃতপক্ষে রিপোর্ট দুটিতে উল্লিখিত তথ্যাবলীর মধ্যে কোনো বিরোধী নেই। একই ইস্যুর দুটি দিক নিয়ে রিপোর্ট দুটি লেখা হয়েছে। কিন্তু উপস্থাপনগত কারণে আপাত দৃষ্টিতে দু্টি রিপোর্টের তথ্যে এক ধরনের ‘বৈপরীত্য’ তৈরি হয়েছে। ‘দ্য ওয়্যার’ এর রিপোর্টটি জয়-সংক্রান্ত মামলায় অভিযুক্ত শফিক রেহমানের পক্ষে গিয়েছে। এবং আর আপাত তৈরি হওয়া ‘বৈপরীত্য’র কারণে পিটিআই’ এর রিপোর্টটি শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের দাবির পক্ষে গিয়েছে।

এখন দুটি রিপোর্টে মধ্যে তৈরি হওয়া ‘আপত বৈপরীত্য’টা কী বুঝে নেয়া যাক।

দ্য ওয়্যার এর রিপোর্টের শিরোনামেই স্পষ্ট যে, শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার যে অভিযোগ এনেছে তার আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মীমাংসিত যেই মামলাটিতে ব্যবহৃত তথ্যকে অবলম্বন ধরে বাংলাদেশে জয়-সংক্রান্ত মামলা (প্রথমে জিডি ছিল) দায়ের করা হয়েছে, সেই মামলার শুনানিতে আদালত ‘জয়কে শারিরীকভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা’ বিষয়ক অভিযোগটি খারিজ করে দিয়েছিলেন।

অর্থাৎ, মার্কিন আদালত জয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ঘুষ লেনদেনের যে মামলায় এক বাংলাদেশিসহ তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন তা তাদের অবৈধভাবে তথ্য সংগ্রহের জন্য, জয়কে হত্যাচেষ্টা বা অপহরণ চেষ্টার জন্য নয়। ‘দ্য ওয়্যার’ মার্কিন সেই আদালতের দেয়ার রায়ের নথির  (যেগুলো পাবলিক ডোমেইনে প্রকাশিত) রেফারেন্সে এসব তথ্য তাদের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে।

অন্যদিকে পিটিআইয়ের রিপোর্টটি হচ্ছে, মার্কিন এক কর্মকর্তারা বক্তব্যের ওপর। বাংলাদেশে জয়-সংক্রান্ত মামলার কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ সরকার মার্কিন সরকারের কাছে সে দেশে জয়-সংক্রান্ত মীমাংসিত মামলাটির সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন তথ্য চেয়েছিল, সেসব তথ্য সরবরাহের ব্যাপারে ওই কর্মকর্তা তার সরকারের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন।

পিটিআই’র রিপোর্টটি হিন্দুস্তান টাইমস, ফার্স্টপোস্ট-সহ আরো কিছু বিদেশী সংবাদমাধ্যমে এসেছে “US helped Bangladesh in uncovering plot to kill Hasina’s son: Official” শিরোনামে। এখানেই বিভ্রান্তির শুরু। এই শিরোনাম দেখে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, যুক্তরাষ্ট্র তাহলে ‘জয়কে হত্যাচেষ্টা’র মামলায় বাংলাদেশ সরকারকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে! মার্কিন ওই কর্মকর্তাই মনে হয় তার বক্তব্যে ‘‘জয়কে হত্যাচেষ্টা’ শব্দযুগলটি ব্যবহার করেছেন।

কিন্তু রিপোর্টের ভেতরে মার্কিন কর্মকর্তার বরাতে যেসব বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে ‘জয়কে হত্যাচেষ্টা মামলা’ জাতীয় কোনো কথা নেই। বরং উদ্ধৃত বক্তব্যে দেখা যায় ওই কর্মকর্তা বাংলাদেশে জয়-সংক্রান্ত মামলাটিকে বুঝাতে ‘this case’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। (পুরো বক্তব্য দেখতে আগ্রহীরা উপরে এই রিপোর্টের দেয়া লিংকে দেখে আসতে পারেন।) হত্যা, নাকি ঘুষ প্রদান, নাকি অন্য কোনো ধরনের case তার উল্লেখ তিনি করেননি।

তাহলে ‘plot to kill Hasina’s son’ কথাটি পিটিআই কোথায় পেল? সম্ভবত, বাংলাদেশ সরকার যে অভিযোগে মামলাটি দায়ের করেছে সেটা বুঝাতে এই এমনভাবে লিখেছে সংবাদ সংস্থাটি। এখানে তাদের ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছাকৃত ভুলটি হচ্ছে, এই কথাটিকে ইনভার্টেড কমা (‘’) এর মধ্যে উল্লেখ না করা। এভাবে উল্লেখ করলে কথাটি মার্কিন কর্মকর্তার নাকি বাংলাদেশ সরকারের ‘দাবি’ তা নিয়ে অস্পষ্টতা সৃষ্টি হত না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্রিকা এভাবেই রিপোর্ট করছে গত কয়েকদিন ধরে। যেমন 18 এপ্রিল ডেকান ক্রনিকলের শিরোনামটি হচ্ছে হুবহু এমন - Second Bangladesh editor named in ‘plot to kill PM's son’.

এখন দুই রিপোর্টের মূল কথাগুলো কী, এবং ‘আপত তৈরি হওয়া’ ‘বৈপরীত্য’টা কী ও কেন হয়েছে তা মোটামুটি স্পষ্ট হওয়ার কথা।

আবারো সারাংশ আকারে বলা যায়- দ্য ওয়্যার’ এর রিপোর্ট মার্কিন আদালতের নথির ভিত্তিতে বলছে বাংলাদেশে দায়ের করা ‘জয়কে হত্যাচেষ্টা’ অভিযোগটি একদমই ঠিক না। আর মার্কিন কর্মকর্তা পিটিআই’র রিপোর্টে বলছেন, ‘বাংলাদেশের মামলাটির ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কিছু তথ্য চেয়ে অনুরোধ করেছিল, আমাদের সরকার সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েছে।’ মামলার মেরিট নিয়ে তার কোনো বক্তব্য নেই। ফলে, রিপোর্ট দুটিতে তথ্যগত কোনো বৈপরীত্য নেই। কিন্তু যখনই ‘plot to kill PM's son’ কথাটা যোগ করা হয়েছে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে তখনই মনে হচ্ছিল, ‘যুক্তরাষ্ট্র তো হত্যাচেষ্টা সংক্রান্ত তথ্য দিয়েই সহায়তা করেছে।’ যদি এমনটা করে থাকে তাহলে তো বাংলাদেশ সরকারের দাবিই সঠিক!

এ পর্যায়ে আমরা দেখবো ২০ এপ্রিল সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় তোলা উপরিউক্ত দুটি রিপোর্টকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম কিভাবে নিয়েছে?

২১ এপ্রিলের দৈনিক প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, জনকণ্ঠ, যুগান্তর, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ইনকিলাব, ইত্তেফাক এবং নিউ এইজ- বাংলাদেশি প্রথম সারির এই ১০টি পত্রিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, মাত্র একটিতে- ইনকিলাব- শফিক রেহমানের পক্ষে যাওয়া রিপোর্টটির উপর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম পাতায় ৩ কলামে সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল “জয়কে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আমলে নেয়নি মার্কিন আদালত”।

বাকি কোনো পত্রিকায় ‘দ্য ওয়্যার’ এর রিপোর্ট সংক্রান্ত কিছু নেই। শুধু জনকণ্ঠের একটি রিপোর্টের শেষ প্যারায় ইঙ্গিতপূর্ণভাবে ডেভিড বার্গম্যানের করা রিপোর্টটিকে ‘শফিক রেহমানের পক্ষে কুটচাল’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র ছিল ‘উপস্থাপন কৌশলের মাধ্যমে’ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নিয়ে যাওয়া পিটিআই’র রিপোর্টটির ক্ষেত্রে। উপরিউক্ত ১০টি পত্রিকার মধ্যে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল ও জনকণ্ঠ- প্রত্যেকটির প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে পিটিআই’র রিপোর্টের অনুবাদ ছাপা হয়েছে। কালের কণ্ঠ ও যুগান্তর পিটিআই’কে সরাসরি অনুবাদ না করে নিজ উদ্যোগে একই তথ্য ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে সংগ্রহ করে ছপিয়েছে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় পাতায়।

ইত্তেফাক, ইনকিলাব, বাংলাদেশ প্রতিদিন কিছুই ছাপেনি এই রিপোর্ট সংক্রান্ত।

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যায়, একই দিন উল্লিখিত অধিকাংশ পত্রিকাই সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে পাওয়া শফিক রেহমান এবং বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতাদের ‘জয় হত্যাচেষ্টা’য় জড়িত থাকার নানা ‘বক্তব্য’ উল্লেখযোগ্য কভারেজে ছাপিয়েছে। যেমন ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ডাবল কলাম শিরৈানাম ছিল, “ফেঁসে যাচ্ছেন পাঁচ বিএনপি নেতা”। সমকালের প্রথম পাতার ডাবল কলাম “জয়কে অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা: ৩০ হাজার ডলারের জোগানদাতা কে?” যুগান্তরের প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলাম “জয় অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্র: মোটা অংকের অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল ৪ ব্যবসায়ীর”।

ব্যতিক্রম একটি বিষয় চোখে পড়েছে কালের কণ্ঠের প্রথম পাতার সিঙ্গেল কলামের “ঢাকাকে তথ্য দেয়ার কথা নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস” রিপোর্টটি। শিরোনামের উপরে শোল্ডার হিসেবে লিখেছে “জয়-সংশ্লিষ্ট মামলা”। এর আগে কালের কণ্ঠ অন্যদের মতো এই জায়গায় লিখতো “জয় অপহরণ ও হত্যা ষড়যন্ত্র”। আবার এই রিপোর্টেই প্রথম বারের মতো মার্কিন আদালতের নথির উদ্ধৃতি দিয়ে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছে। ব্যাপারটিকে ‘দ্য ওয়্যার’ এর রিপোর্টের ‘পরোক্ষ প্রভাব’ হিসেবে বর্ণনা করা যেতেও পারে!

অবশ্য জনকণ্ঠ তাদের প্রথম পাতার “জয় হত্যাচেষ্টা বিষয়ে তথ্য জানতে তদন্ত দল যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে” শিরোনামের রিপোর্টটির নিচের ‘মন্তব্য’টি জুড়ে দিয়ে ‘ব্রিটিশ সাংবাদিক’ বার্গম্যানের করা ‘দ্য ওয়্যার’ এর রিপোর্টের ‘ড্যামেজ কভারের চেষ্টা’ করেছে!

জনকণ্ঠের মন্তব্যটি হচ্ছ--

“শফিক রেহমানের পক্ষে কূটচাল শুরু:
সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতারের পর থেকে তার পক্ষ নিয়ে বিএনপি ও তার সমর্থক বুদ্ধিজীবী মহল থেকে শুরু হয়েছে কূটচাল। গত ১৬ এপ্রিল শফিক রেহমানকে তার ইস্কাটনের বাসা থেকে গ্রেফতার করার পর থেকেই ফেসবুকে বিএনপি ও তাদের সমর্থকসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। এমনকি বিএনপির পক্ষ থেকে এফবিআইকে চিঠি দিয়ে শফিক রেহমান সংক্রান্ত বিষয়ে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়াও বিএনপির পক্ষ থেকে সাংবাদিক শফিক রেহমানের মামলা পরিচালনা ও তার পরিবারের দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে লিখে আদালত অবমাননার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন এমন এক সাংবাদিক যিনি ব্রিটিশ নাগরিক তিনিও সাংবাদিক শফিক রেহমানের পক্ষে বিদেশী পত্রপত্রিকায় লেখালেখি শুরু করে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করছেন।”


Note: এই লেখা প্রকাশের আগেই ২১ এপ্রিল ব্রিটেনের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা মার্কিন আদালতের বক্তব্য সম্বলিত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে।  এই রিপোর্টটি ওয়্যার এর রিপোর্টের মতোই বাংলাদেশের মিডিয়ায় কিভাবে ট্রিটেড হয় তা পরে আপডেট করা হবে।