সোমবার, এপ্রিল ১০, ২০১৭

মিডিয়ার চোখে ‘দিল্লি দর্শন’


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়া দিল্লি সফর চলছে। ৭ এপ্রিল শুরু হওয়া সফর এই মুহুর্তে দুই দেশের মিডিয়ায় প্রধান ইস্যু। ৮ এপ্রিল মোদি-হাসিনার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এরপর স্বাক্ষরিত হয় বেশ কিছু সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি। এর মোট সংখ্যা ২২, ৩২ ৩৬- এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে খোদ সরকারি সূত্রগুলোর মধ্যেই। তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৬টি চুক্তি ও ১৬টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে। আর বেসরকারি পর্যায়ে হয়েছে বাকি ১২ বা ১৪টি চুক্তি/স্মারক। বৈঠক শেষে দুই নেতা প্রেস ব্রিফিং করেছেন। এর পাশাপাশি ছিল কিছু 'সাইড ইভেন্ট'।
সফরের আগে থেকে মূল আলোচনায় ছিল দুটি ইস্যু- প্রতিরক্ষা চুক্তি ও তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি। মোদি-হাসিনা বৈঠকে এ দুটি বিষয়ে কী হয়েছে তা নিয়েই আগ্রহ ছিল সাধারণ মানুষ থেকে বিশেষজ্ঞ সবার।

তো, ৮ এপ্রিলের এসব ঘটনা বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সংবাদমাধ্যমগুলো কিভাবে কভার করেছে তা সংক্ষিপ্তভাবে এখানে তুলে দেখার চেষ্টা করা হবে। সংবাদমাধ্যম বলতে এখানে বাছাই করা হয়েছে এই পত্রিকাগুলো- প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, যুগান্তর, সমকাল, কালের কণ্ঠ ও ইত্তেফাক। পাশাপাশি উল্লেযোগ্য কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের রিপোর্টিং নিয়েও কিছুটা আলোকপাত করা হবে।


৯ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ৫ কলামে শিরোনাম, "আমরাই তিস্তা চুক্তি করবো"। শিরোনামের উপরে 'শোল্ডার', "শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর নরেন্দ্র মোদির অঙ্গীকার"। উভয় নেতার প্রেস ব্রিফিংয়ের হাস্যোজ্জল ছবি রয়েছে পাশেই।

সমকালের লীড শিরোনাম ছিল, "তিস্তা চুক্তিও হবে"। সঙ্গে হ্যাঙ্গার, "মমতাকে পাশে রেখে বললেন মোদি"।

ইত্তেফাকের লীড নিউজ, "হাসিনার আমলেই তিস্তা চুক্তি হবে: মোদির প্রতিশ্রুতি"। "উদ্বেগ ও অগ্রাধিকারের ব্যাপারে বোঝাপড়া হয়েছে: শেখ হাসিনা"-এটাকে যোগ করা হয়েছে হ্যাঙ্গার হিসেবে।

এই তিনটি পত্রিকার উপরিউক্ত তিনটি শিরোনামের দৃষ্টিকোণ (স্লান্ট) বাছাই ও শব্দচয়ন লক্ষ্যণীয়। তিন পত্রিকাই মোদির কথিত আশ্বাসকে সর্বোচ্চ আস্থা ও গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে এবং সে কারণেই তার বক্তব্যকে ওই দিনের অন্যসব কিছুর চেয়ে বড় করে এবং জোরালো শব্দচয়নে উপস্থাপন করেছে। 'দ্রুতই সমাধান হবে' মোদির এমন আশ্বাসকে প্রথম আলো 'আশ্বাস' না বলে 'অঙ্গীকার' এবং ইত্তেফাক 'প্রতিশ্রুতি' বলেছে। ভারতীয় নেতার মুখের কথাকে 'অঙ্গীকার' 'প্রতিশ্রুতি' ভাবতে চায় এই দুই পত্রিকা।

এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় যুগান্তর ও অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলাট্রিবিউনের দুটি শিরোনাম উল্লেখ করা যায়। ৯ এপ্রিল যুগান্তরের ১৪তম পৃষ্ঠায় ডাবল কলাম শিরোনাম হচ্ছে, "তিস্তার পানি বন্টনে নেই অঙ্গীকার"। প্রতিবেদনের প্রথম বাক্যটি হচ্ছে, "তিস্তা চুক্তি নিয়ে অঙ্গীকার নয়, এবারও শুধুই আশ্বাস পেল বাংলাদেশ"। ৮ এপ্রিল বাংলাট্রিবিউনের "তিস্তা নিয়ে আশ্বাস, অঙ্গীকার নেই" শিরোনামের প্রতিবেদনের প্রথম কয়েকটি বাক্য, "তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সরকার শুধু আশ্বাসই দিয়েছে। তবে কোনও অঙ্গীকার করেনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বক্তব্যেও সেই আশ্বাসের বিষয়ই ফুটে ওঠেছে।"

অর্থাৎ, যুগান্তর ও বাংলাট্রিবিউন মোদির যে কথাকে 'অঙ্গীকার নয়, শুধুই আশ্বাস' বলছে, প্রথম আলো সেটাকেই 'অঙ্গীকার' বলেছে! (আবার যুগান্তরে নিউজটির ট্রিটমেন্ট খেয়াল করার মতো। সফরের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুতে বাংলাদেশের অপ্রাপ্তির বিষয়টি প্রথম পাতায় না দিয়ে পত্রিকাটি নিয়ে গেছে ১৪তম পৃষ্ঠায়!)

দৈনিক সমকাল "তিস্তা চুক্তিও হবে" শিরোনাম করে সাথে "মমতাকে পাশে রেখে বললেন মোদি" কথাটি যোগ করে মোদির বক্তব্যে আস্থা রাখার জন্য পাঠককে প্ররোচিত করেছে। মানে, তিস্তা চুক্তি নিয়ে ঝামেলা পাকানো মমতাকে পাশে নিয়ে যেহেতু বলেছেন, সেহেতু মমতার বোধয় এখন আর চুক্তি নিয়ে কোনো আপত্তি নেই! মমতা যে তিস্তা বাদ দিয়ে অন্য কয়েকটি নদীর পানি বণ্টন করার প্রস্তাব দিয়েছেন সেই খবর সমকাল ২য় পৃষ্ঠায় ছাপিয়েছে 'তিস্তা নিয়ে যৌথ সমীক্ষা চান মমতা" শিরোনামে। মমতা যে তিস্তা নিয়ে তার আগের গোপনে 'বেঁকে থাকা'টা প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন, এবং এর কারণে তিস্তা চুক্তি যে আরও বেশিভাবে ঝুলে গেল- সে প্রসঙ্গটিকে মোটেও পাত্তা দিতে চায় না সমকাল।

ডেইলি স্টারের লীড স্টোরির শিরোনাম ছিল, "Warmth flows, water not yet"। যুগান্তরের লীডের শিরোনাম, "প্রতিরক্ষায় সমঝোতা, তিস্তায় আশ্বাস"। ডেইলি স্টারের শিরোনামটিতে সুক্ষ্ম কটাক্ষ আছে। "(সম্পর্কে) উষ্ণতা বইলেও, পানি এখনো বইছে না"। বাংলাদেশ-ভারতের 'একপক্ষীয়' সম্পর্কের ইতিহাস বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের একটি পত্রিকার জন্য এমন শিরোনামকে যুৎসই বলা যায়। যুগান্তরের শিরোনামও ভারসাম্যপূর্ণ। পত্রিকাটি মোদির কথাকে সাধারণ 'আশ্বাস' হিসেবেই দেখেছে। ভারতীয় নেতাদের দ্বারা বাংলাদেশকে অতীতে দেয়া নানা আশ্বাস পূর্ণ না করার বিষয়টি স্মরণে রাখলে এই অতি সাধারণ মৌখিক 'আশ্বাস'কে 'প্রতিশ্রুতি' বা 'অঙ্গীকার' হিসেবে দেখার যৌক্তিকতা নেই।

কালের কণ্ঠ লীড শিরোনাম করেছে, "মোদির আশ্বাস, মমতার বিকল্প"।


উপরে শুধু সংশ্লিষ্ট পত্রিকাগুলোর প্রধান শিরোনাম তুলে ধরা হয়েছে, কারণ দিনের প্রধান শিরোনামটির আলোকেই সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে পাঠকের প্রাথমিক ধারণা আকার লাভ করতে শুরু করে।

এবার এই ছয়টি পত্রিকারই ওই দিনের একই ইস্যুতে অন্যান্য সংবাদ-মতামত ভিত্তিক প্রতিবেদনগুলির দিকে খেয়াল করা যায়। প্রথম আলো প্রধান শিরোনামের বাইরে প্রথম পাতায় আরও তিনটি এবং ভেরতরে একাধিক পাতায় আরও ৫টি প্রতিবেদন ও মতামত ছাপিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে কামাল আহমেদের লেখা 'তৃষ্ণা মিটল না বাংলাদেশের" শিরোনামের লেখাটিতে তিস্তা চুক্তি না হওয়া নিয়ে মৃদু সুরের আফসোস ফুটে ওঠেছে। এর বাইরে প্রথম আলোর লীড নিউজসহ এতগুলো প্রতিবেদনে কোথাও কোনো আফসোস-প্রশ্ন-অপ্রাপ্তির অনুভূতি নেই! সাধারণত এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে 'বিশেষজ্ঞদের মতামত' বা সংশ্লিষ্ট ইস্যুর সাথে সরাসরি যার সম্পর্কতি তাদের মতামত (যেমন তিস্তা পাড়ের মানুষ) নিয়ে যে বিশেষ প্রতিবেদন করার প্রচলন আছে সংবাদমাধ্যমে সে ধরনের কিছুই ছিল না এদিনের প্রথম আলোতে। বরং, তিস্তা চুক্তির বিকল্প হিসেবে নতুন কয়েকটি নদীর পানি বণ্টনের প্রস্তাব করে মমতা যে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেই বক্তব্যভিত্তিক সংবাদটিকে গুরুত্বহীন করে ভেতরের পাতায় ছাপানো হয়েছে। অথচ, মমতার এই প্রস্তাব মোদির 'আমরাই তিস্তা চুক্তি করবো' আশ্বাসের ভিত্তি পুরোই নড়বড়ে করে দেয়।

সার্বিকভাবে বললে, প্রথম আলো 'তিস্তা চুক্তি হবে' মোদির এই আশ্বাসকে আস্থার সাথে প্রচার করার পাশাপাশি তিস্তার জন্য মৃদু কণ্ঠে 'আফসোস' করেছে। একই সাথে তিস্তা না হওয়ার যে আশঙ্কা মমতার কথায় স্পষ্ট হয়েছে সেটিকে অনেকটা পাশ কাটিয়েছে পত্রিকাটি।

৮ তারিখের ঘটনাবলীর সার্বিক কভারেজে সমকালে লীড নিউজের বাইরে প্রথম পাতায় আরও তিনটি প্রতিবেদন ছিল। ২য় পাতায় ছিল একাধিক ছবিও প্রতিবেদন। সর্বত্রই ভারতীয় আশ্বাসের পক্ষের বয়ান। কোনো প্রশ্ন নেই, প্রথম আলো যেমন 'মৃদু আফসোস' সম্বলিত একটি লেখা ছাপিয়েছে, সমকাল সেটারও গরজবোধ করেনি। প্রথম পাতায় সমকাল সম্পাদক গোলাম সরওয়ারের 'আমরা তোমাদের ভূলবো না' শিরোনামের মন্তব্যধর্মী প্রতিবেদনটি ছিল ভারতীয় সেনাদের সম্মাননা প্রদান নিয়ে লেখা। প্রধানমন্ত্রীর সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে দৃষ্টিকটুভাবে নীরব এদিনের সমকাল।

ইত্তেফকা লীড নিউজের পাশপাশি প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলামে প্রতিবেদনের শিরোনাম করেছে "এই সফরে উভয় দেশই রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে"। এটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের বক্তব্যভিত্তিক প্রতিবেদন, বাংলাদেশের কোনো বিশেষজ্ঞের মতামত নয় এটি। ভারতীয় পত্রিকার ভাষ্য দিয়ে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার অংক কষছে ইত্তেফাক। একটু কষ্ট করে বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন তা জানার প্রয়োজনবোধ করেনি পত্রিকাটি!

যুগান্তরের লীড নিউজের বাইরে যে সব প্রতিবেদন আছে সেগুলোর একটির কথা উপরেই বলা হয়েছে। বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন "তিস্তার পানি বন্টনে নেই অঙ্গীকার"। আর শেষের পাতায় একজন বিশেষজ্ঞের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সিঙ্গেল কলাম একটি প্রতিবেদন ছিল, "বহু প্রত্যাশিত তিন ইস্যুর সুরাহা হয়নি: সাবেক রাষ্ট্রদূত শফিউল্লাহ"। তিনি তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যা বন্ধ এবং পাটপণ্যের ওপর এন্টি ডাম্পিং ডিউটি প্রত্যাহার- এই তিন ইস্যুর কথা বলেছেন। যমুনা টেলিভিশনকে দেয়া জনাব শফিউল্লাহর এক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে যুগান্তরের প্রতিবেদনটি তৈরি। লক্ষ্য করার বিষয় হল, সীমান্ত হত্যা বন্ধ নিয়ে মোদি-হাসিনা বৈঠকে কোনো কথা হয়েছে কিনা, কিম্বা হলে কী হয়েছে- তা নিয়ে বাংলাদেশি মিডিয়ার কোনো আগ্রহই নেই! উল্লিখিত পাঁচটি পত্রিকা ছাড়াও অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমেও এ নিয়ে কোনো বাতচিত ছিল না বললেই চলে।


লীড নিউজের শিরোনামে এবং ভেতরে যে একটু কটাক্ষ আছে তিস্তা চুক্তি না হওয়া নিয়ে, এর বাইরে বিশেষ কিছু ছিল না ৯ এপ্রিলের ডেইলি স্টারে। শেখ হাসিনা ও মোদির বক্তব্যকে আলাদাভাবে হাইলাইট করার পাশাপাশি মমতার বিকল্প প্রস্তাবের খবরটিকে প্রথম পাতায় ছাপিয়েছে "Teesta has no water to share" শিরোনামে। যেসব চুক্তি ও সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ বাংলাদেশের ওপর সেগুলোর ইতি-নেতিবাচক প্রভাব নিয়েও কোনো প্রতিবেদন/বিশ্লেষণ নেই। তিস্তা নিয়ে ভেতরে একটি 'কলাম' ছাপা হয়েছে ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জির। শিরোনাম 'The Teesta runs through it' (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রথমে প্রকাশিত)। সেখানে তিনি দাবি করেছেন, "তিস্তা চুক্তি না হলেও আলোচনায় যতটুকু পানি পাওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে প্রায় ততটুকু এখনই বাংলাদেশ পাচ্ছে।" ভারতীয় একজন কূটনীতিকের অবশ্য এমন দাবি করে কলাম লেথা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে একটি বিশেষ দিনে সেটিকে একমাত্র কলাম হিসেবে বাংলাদেশি পত্রিকায় ছাপানো কি স্বাভাবিক!

কালের কণ্ঠে ব্যতিক্রমী দুয়েকটি প্রতিবেদন ছিল। যেমন প্রথম পাতায় একটির শিরোনাম, "বিশ্লেষকদের মত: তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় মানুষ হতাশ হবে"। দ্বিতীয় পাতায় আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম, "হতাশ তিস্তা পারের মানুষ: তিস্তা বাঁচলেই হামরা বাঁচবো"। বাকি ৫টি পত্রিকায় এই দুটি রিপোর্টের এঙ্গেলের কোনো রিপোর্ট ছিল না।

তবে কালের কণ্ঠের “নতুন উচ্চতায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক” শিরোনামের সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষে মনোভাব। লেখা হয়েছে, “বহুল প্রত্যাশিত তিস্তা চুক্তি এবার যদিও হয়নি, এ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা আশা রাখি।” ২০১০ ও ২০১১ সালে তিস্তা নিয়ে ভারতের আগের প্রধানমন্ত্রীর (মনমোহন সিং) একই রকম আশ্বাস যে গত ৭ বছরে বাস্তবায়িত হয়নি, সেই তথ্যের কোনো উল্লেখ না করেই দিল্লির সুরে ‘আশার বাণী’ শোনানো হয়েছে পাঠককে।

মজার বিষয় হল, এই ‘আশার বাণী’কে যৌক্তিক করতে গিয়ে সম্পাদকীয়তে বিভ্রান্তিকর তথ্যের আশ্রয় নিয়েছে পত্রিকাটি। এক জায়গায় লেখা হয়েছে, “২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকালে ২০০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তিতে নেওয়া প্রকল্পগুলোও বাস্তবায়নের পথে।” কিন্তু গত ১৪ মার্চ কালের কণ্ঠেরই সিস্টার কনসার্ন মিডিয়া হাউজ বাংলানিউজের রিপোর্টের শিরোনাম ছিল “শুরুই হয়নি ১৪ প্রকল্প, তবু তৃতীয় এলওসি’র প্রস্তুতি!” রিপোর্টটির প্রথম প্যারাটি এখানে তুলে দেয়া প্রাসঙ্গিক হবে, “এক বছর আগে ১৪টি প্রকল্পের আওতায় ভারত দুই বিলিয়ন ডলার (২০০ কোটি ডলার) নমনীয় ঋণ (এলওসি) দেয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় এ ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা (তখনকার এক ডলার সমান ৮০ টাকা ধরে)। ২০১৬ সালে ৯ মার্চ দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি হয়। ১৪টি প্রকল্পের আওতায় ঋণ দেয় ভারত। অথচ এক বছর পেরিয়ে গেলেও এসব প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য। বাস্তবে কোনো কাজই এখনও শুরু হয়নি। এরই মধেই শুরু হয়েছে তৃতীয় এলওসি’র প্রস্তুতি।”

গত মার্চ মাসেই যুগান্তরের এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্টের শিরোনাম ছিল, “ভারতীয় ঋণে ১৪ প্রকল্পের একটিও বাস্তবায়নে যায়নি”। অথচ, চলতি সফরে ভারতের ঘোষিত সাড়ে ৪০০ ডলারের ঋণকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরতে গিয়ে আগের উদাহরণ টেনে কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের পথে! শুরু না হওয়া প্রকল্পকে 'বাস্তবায়নের পথে' বলায় হয়তো বড় ভুল নেই, কিন্তু বিভ্রান্তি আছে। কারণ 'বাস্তবায়নের পথে' বললে যে কেউ ধরে নেবে শুরু হয়েছে, বাস্তবায়ন চলছে। কালের কণ্ঠ তার পাঠককে এটাই বুঝাতে চায়, 'শুরু হয়নি' বুঝতে দিতে চায় না! ২০১০ সালে ভারতের দেয়া ১০০ কোটি ডলারের ঋণে গৃহীত প্রকল্পের ক্ষেত্রেও এমন চাতুরি করেছে কালের কণ্ঠ। যে ৮টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে সেগুলোর কথা বলেছে। কিন্তু যে ৬টি প্রকল্পের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে ঋণ ছাড়ে বিলম্বের কারণে সেগুলোর কোনো উল্লেখ করেনি (সূত্র: সমকাল জানুয়ারি ২০১৭)।


৫টি পত্রিকার একদিনের কভারেজ সংক্রান্ত উপরের চিত্র থেকে মোটামুটি তিনটি প্রবণতা পাওয়া যাচ্ছে।

এক. তিস্তা চুক্তি না হওয়া, এবং এর ফলে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টিকে হাইলাইট করার পরিবর্তে 'ভবিষ্যত হবে বলে দেয়া আশ্বাস'কে হাইলাইট করা হয়েছে। এ কাজ করতে গিয়ে প্রয়োজনে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।

দুই. ভারত যে অতীতে বহু ইস্যুতে, এবং বিশেষ করে তিস্তা ইস্যুতে একাধিকবার আশ্বাস দিয়েও রাখেনি সেটাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি কেউ (প্রথম আলোয় কামাল আহমেদের সংবাদ বিশ্লেষণটি কিছুটা ব্যতিক্রম)।

তিন. যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষিরত হয়েছে সেগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত হওয়া, না হওয়া নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনা নেই।

চার. সফরের আগে থেকে সবচেয়ে আলোচিত প্রতিরক্ষা চুক্তি না হলেও এ সংক্রান্ত যে তিনটি সমঝোতা হয়েছে সেগুলো নিয়ে পাঠকের জানার আগ্রহ মেটানোর কোনো তাড়না ছিলনা কোনো পত্রিকার।


এর বাইরেও আরও কিছু প্রবণতা লক্ষ্যণীয় ছিল। যেমন, অপেক্ষাকৃত হালকা বিষয় ও 'সাইড স্টোরি'গুলোকে বেশি করে সামনে নিয়ে আসা। সমকালের প্রথম পাতায় শিরোনাম, "দুই প্রধানমন্ত্রীর হাসি আর থামে না"। মোদির প্রটকোল ভেঙে বিমানবন্দরে এসে শেখ হাসিনাকে বরণ করে নেয়ার ঘটনায় মিডিয়ার ব্যাপক উৎসাহ ছিল। এরপর প্রণবের জন্য ইলিশ রাঁধতে রান্না ঘরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রবেশের বিষয়টিকে ‘বাঙালীর আতিথেয়তার নিদর্শন’ আখ্যা দিয়ে রিপোর্ট হয়েছে! যদিও শেখ হাসিনা নিজেই দিল্লিতে অতিথি! অবশ্য এক্ষেত্রে শেখ হাসিনা কর্তৃক প্রটোকল ভাঙার কথাটি মিডিয়া হাইলাইট করেনি। যেমন ডেইলি স্টারের শিরোনাম “প্রণবকে 'ভাপা ইলিশ' রান্না করে খাওয়ালেন হাসিনা”, বাংলানিউজের শিরোনাম, “প্রণবকে ভাপা ইলিশ রেঁধে খাওয়ালেন হাসিনা”, কালের কণ্ঠের শিরোনাম, “প্রণবের জন্য নিজ হাতে 'ভাপা ইলিশ' রাঁধলেন হাসিনা”। ইলিশ খাওয়া আর খাওয়ানো নিয়ে বাংলাদেশি মিডিয়ার উৎসাহ যেন তিস্তার চেয়েও বেশি। এ ধরনের আরো কিছু শিরোনাম, “বাংলাদেশে গিয়ে পেট ভরে ইলিশ-ভাত খাবো: মমতা” (ডেইলি স্টার), “শেখ হাসিনাকে আপ্যায়নে মেলেনি ইলিশ” (বিডিনিউজ), “শেখ হাসিনাকে আপ্যায়নে ইলিশ নেই” (প্রথম আলো), “মেলেনি ইলিশ, ভরসা ভেটকি-গলদা আর চিতল” (ইত্তেফাক), “হাসিনার জন্য ভেটকি, মোদিকে বেগুনভাজা” (প্রথম আলো) ইত্যাদি। শেখ হাসিনাকে মমতার ‘তুমি-আপনি’ বলে সম্বোধন, উপস্থাপক কর্তৃক দুই নেতাকে ‘স্টেপ ডাউন’ বলার কৌতুক ইত্যাদি হালকা খবরের ছড়াছড়ি ছিল বেশিরভাগ পত্রিকা/অনলাইনে।

10-04-17

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন