বৃহস্পতিবার, জানুয়ারী ০৪, ২০১৮

রক্তভেজা সাংবাদিকতা, এতিমের কান্নাভেজা সাংবাদিকতা


কদরুদ্দীন শিশির:

নববর্ষের প্রথম দিনের কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম আপনাদেরকে পড়াবো। শুরু করছি--

কালের কণ্ঠের শিরোনাম, "হবিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে মাদক সম্রাটের মৃত্যু"

জাগোনিউজের শিরোনাম, "হবিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে ‘মাদক সম্রাট’ নিহত"

বাংলাট্রিবিউনের শিরোনাম, "হবিগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলা, গুলিতে ‘মাদক ব্যবসায়ী’ নিহত"

বাংলানিউজের শিরোনাম, "চুনারুঘাটে পুলিশের গুলিতে মাদক ব্যবসায়ী নিহত"

বিডিনিউজের শিরোনাম, "হবিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে সাবেক কাউন্সিলর নিহত"

যুগান্তরের শিরোনাম, "হবিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে সাবেক কাউন্সিলর নিহত"

মানবজমিনের শিরোনাম, "চুনারুঘাটে পুলিশের গুলিতে সাবেক কাউন্সিলর নিহত"

এনটিভি অনলাইনে শিরোনাম, "পুলিশের অভিযানে হামলা, গুলিতে সাবেক পৌর কাউন্সিলর নিহত"

ডেইলি স্টার, "Ex-councilor among 2 killed in Habiganj, Feni ‘gunfights’

প্রথম আলোর অনলাইন ভার্সনে এদিন এ ঘটনা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন ছিলো না। তবে পরদিন প্রিন্ট ভার্সনে প্রথম আলোর শিরোনাম, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাবেক কাউন্সিলরসহ নিহত ৩'।

পুলিশের গুলিতে নিহত সাবেক কাউন্সিলর ইউনুছের লাশ (বাংলাট্রিবিউন)

আপাতত শিরোনাম পড়ানো এখানেই শেষ।

২০১৭ এর শেষ দিন- ৩১ ডিসেম্বর দিবাগত রাতের বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছিলো ৩টি। প্রথম আলোর শিরোনামে তা দেখা যাচ্ছে। পরদিন সকালে এসব সংবাদ অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও টিভিতে এসেছে। উপরের শিরোনামগুলো পত্রিকাগুলোর ওয়েব ভার্সন থেকেই নেয়া। ৩টি ঘটনার মধ্যে আমি একটিকে আলোচনার জন্য বাছাই করেছি।

উপরের শিরোনামগুলো মিলিয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তাতে আমরা জানতে পারছি, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে একজন 'মাদক সম্রাট' পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। তিনি এক কালে পৌর কাউন্সিলর ছিলেন। আমরা আরও জানতে পারছি যে, এই 'মাদ্রক সম্রাট' পুলিশের ওপর হামলা করতে গিয়েছিলেন বলে পুলিশ তার ওপর গুলি করে।

(বিশ্লেষণের জন্য সংবাদগুলোর ভেতরে একটু পরে যাবো। তবে শিরোনামগুলোর তথ্য মিলানোর কারণে 'প্রকাশিত ঘটনা'র মূল তথ্যগুলো চলে এসেছে।)
এ পর্যন্ত জানার পর আপনাদেরকে নতুন আরেকটি সংবাদ পড়াবো। শিরোনাম "এসআই আতাউরের গুলিতে নিহত হন বিএনপি নেতা: ওসি"। ঘটনার ৩দিন পর ৪ জানুয়ারি অনলাইন নিউজ পোর্টাল 'পরিবর্তন ডটকম' প্রকাশিত প্রতিবেদন এটি। যদিও লম্বা হয়ে যাবে, তবু প্রতিবেদনটি হু্বহু কপি-পেস্ট করে নিচে দিচ্ছি--
//
বিএনপি সমর্থিত সাবেক পৌর কাউন্সিলর ও কাঠ ব্যবসায়ী ইউনুছ মিয়া হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) কে এ এম আজমিরুজ্জামান জানিয়েছেন, নিজেকে রক্ষার জন্য এসআই আতাউর গুলি চালালে ঘটনাস্থলে নিহত হন ইউনুছ।

তিনি জানান, রোববার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার মাগুরউন্ডা গ্রামে অভিযান চালায় পুলিশ। সেখানে সাবেক পৌর কাউন্সিলর ইউনুছ আলীসহ কয়েকজন মাদক সেবন করছিলেন। গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের উপর তাৎক্ষণিক ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালান ইউনুছ। এতে এসআই আতাউর রহমান গুরুতর আহত হন। এসময় আত্মরক্ষার্থে গুলি চালান এসআই আতাউর রহমান। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন ইউনুছ মিয়া।

তবে নিহতের স্ত্রী কাজী শাহেনা এ প্রতিবেদককে জানান, পুলিশ আমার স্বামীকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তিনি দাবি করে বলেন, আমার স্বামী ছিলেন একজন কাঠ ব্যবসায়ী। তার আয় রোজগারও ভালো ছিল। এজন্যই পুলিশ তার কাছে প্রায়ই চাঁদা দাবি করত। সে দিতে অস্বীকার করায় তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পুলিশ। পরে পুলিশ মাদক ব্যবসার অভিযোগ এনে বাড়িতে আমাদের হয়রানি ও নির্যাতন করে।

মাস চারেক আগে পুলিশের হয়রানি ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমি আদালতে একটি মামলা দায়ের করি। আর এ মামলা তুলে নিতে পুলিশ আমার স্বামীকে হুমকি দিতে থাকে। এ কারণেই আমার স্বামীর উপর মাদক ব্যবসার অভিযোগ এনে তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।

নিহতের স্বজন ও পুলিশের পাল্টাপাল্টি এই বক্তব্য নিয়ে রহস্য আরো ঘনীভূত হচ্ছে।

জানা যায়, ঘটনার চার দিন পেরিয়ে গেলেও এখনও নিহত ইউনুসের পরিবারে চলছে কান্নার রোল। কিছুতেই থামছে না তাদের আজাহারী। কান্নায় যেন আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। তাদের কান্নায় যেন পুরো গ্রাম স্তব্ধ হয়ে গেছে। গ্রামজুড়ে বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা। পুরো গ্রামই যেন শোকে কাতর। নিহত ইউনুস আসলেই মাদক ব্যবসায়ী কি না- এ বিষয়ে প্রতিবেশী কেউই পুলিশের ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নন।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রতিবেশী জানান- নিহত ইউনুস নিয়ে কথা বলতে পুলিশের নিষেধ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিবেশী জানান, ইউনুসের বুকে তিনটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে।

নিহত ইউনুছের সন্তান সুমি আক্তার ও শাকিব আহমেদ স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। এছাড়াও লুবনা আক্তার একই স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে। ছোট মেয়ে সুবা আক্তারের বয়স তিন বছর।
//
পরিবর্তন ডটকমের প্রতিবেদনের সাথে এই ছবিটি দেয়া হয়েছে--
বাবার লাশ বাড়িতে আনার পর নিহত ইউনুছের চার শিশু সন্তানের কান্নার এই ছবিসহ পরিবর্তন ডটকমের প্রতিবেদন

পরিবর্তনের রিপোর্ট
২.
আমার আলোচ্য লেখার শিরোনাম করেছি, "রক্তভেজা সাংবাদিকতা, এতিমের কান্নাভেজা সাংবাদিকতা"। এর মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছি, আমরা সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গরা অনেক ভাল কাজের পাশাপাশি কখনো কখনো এমন কাজও করছি, যাতে যে কারো মনে হতে পারে- অন্যায় হত্যাকাণ্ডের শিকার কোনো কোনো মানুষের শরীরের রক্ত আমাদের হাতে লেগে আছে, কোনো কোনো এতিমের আরশ-কাঁপানো কান্নায় আমাদের কলম ভিজে আছে। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যায় আমরা সাংবাদিকরা নিজেদের অজান্তেই 'খুনি'র তালিকায় নিজেদের নাম তুলে দিচ্ছি।

কেন আমার এমনটি মনে হচ্ছে? সাংবাদিকদের নাম আবার 'খুনি'র তালিকায় উঠবে কেন? এখন ঘটনাটি নিয়ে ১ জানুয়ারির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের সাথে ৪ জানুয়ারির পরিবর্তন ডটকমের খবরটিকে মিলিয়ে দেখি। হয়তোবা বুঝা যাবে আমরা এমন মনে হওয়ার কারণ।

কালের কণ্ঠের প্রতিবেদন দিয়েই শুরু করা যাক। বিকৃতিমুক্ত রাখতে পুরো প্রতিবেদনটি এখানে কপি-পেস্ট করলাম--
//
শিরোনাম: "হবিগঞ্জে পুলিশের গুলিতে মাদক সম্রাটের মৃত্যু"

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে পুলিশের গুলিতে সাবেক এক পৌর কাউন্সিলরের মৃত্যু হয়েছে। তবে এলাকায় তিনি মাদক সম্রাট বলে খ্যাত। তার নাম ইউনুছ মিয়া বলে জানা গেছে। এ সময় ওই মাদক সম্রাটের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে এক দারোগা গুরুতর আহত হয়েছেন। রবিবার দিবাগত রাত ১১টার দিকে চুনারুঘাট উপজেলার দেওরগাছ ইউনিয়নের মাগুরউন্ডা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, চুনারুঘাট থানার দারোগা আতাউর রহমান কনস্টেবল নিয়ে ওই গ্রামে এক আসামি ধরতে যান। সেখানে একটি ঘরে আসামি আছে সন্দেহে তারা ঢুকে পড়েন। ওই সময় ওই ঘরে ৪ ব্যক্তি মাদক সেবন করছিলেন। তাদের একজন ছিলেন মাদক সম্রাট ইউনুছ মিয়া। তাৎক্ষণিক তিনি একটি ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই দারোগাকে আহত করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় এসআই আতাউর রহমান নিজের পিস্তল থেকে গুলি ছুড়লে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।
সাংবাদিকদের কাছে এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন সহকারী পুলিশ সুপার রাজু আহমেদ।
//
কালের কণ্ঠের পুরো রিপোর্ট
কালের কণ্ঠের রিপোর্টটি শুধু পুলিশের বক্তব্য দিয়ে তৈরি। নিহতের পরিবার-স্বজন বা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কারো কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু রিপোর্টটির ইন্ট্রো থেকে শুরু করে শেষ লাইনের আগ পর্যন্ত এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন রিপোর্টার নিজেই প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। কিন্তু কোনো আসামি ধরতে পুলিশের গোপন অভিযানে সাংবাদিক উপস্থিত থাকার যেহেতু কোনো সুযোগ নেই, ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায়- রিপোর্টার পুলিশের কাছ থেকেই এসব তথ্য বা বক্তব্য পেয়েছেন।

একজন লোক (সে অপরাধী কীনা সেটা এখানে বিবেচ্য নয়) পুলিশের গুলিতে মারা গেছে, আর সেই ঘটনা সম্পর্কে হত্যাকারী পক্ষের ভাষ্যকে 'পুলিশের দাবি' আকারে উপস্থাপন না করে 'তথ্য' আকারে উপস্থাপন করলেন সাংবাদিক! নিহত ব্যক্তির পরিচয় লিখলেন 'মাদক সম্রাট'। কিন্তু এলাকার কোনো লোকের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করলেন না লোকটি আদৌ 'মাদক সম্রাট' হিসেবে এলাকায় খ্যাত কীনা। এমনকি নিহতের পরিবার কী বলছে- তাও জানার চেষ্টা করলেন না। হত্যাকারী পক্ষ যা বলেছে তাতেই সন্তুষ্ট হয়ে শেষে যোগ করে দিলেন, "সাংবাদিকদের কাছে এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন সহকারী পুলিশ সুপার রাজু আহমেদ।" (যদিও এখানে সত্যতা 'স্বীকার' এর বিষয় নয়, 'নিশ্চিত করা'র বিষয়!)

যেই পক্ষ (পুলিশ) হত্যা করলো (বিচারবহির্ভূতভাবে), সেই পক্ষের কাছ থেকে হত্যকাণ্ডের বর্ণনা আর নিহতের ব্যাপারে নেতিবাচক তথ্যের 'নিশ্চিয়তামূলক' সনদ নিয়ে তা পাঠককে 'দেখালেন' সাংবাদিক!

কিন্তু তার তিনদিন পর যখন অন্য পত্রিকার সাংবাদিক ঘটনা সম্পর্কে নিহতের স্বজন ও এলাকাবাসীর কাছে জানতে গেলেন তখন দেখা যাচ্ছে, পুলিশের কাছ থেকে কালের কণ্ঠ কর্তৃক 'সত্যায়িত' করে আনা 'তথ্যগুলো' বদলে যাচ্ছে।

কালের কণ্ঠ (পুলিশের বরাতে) জানিয়েছিলো, নিহত ব্যক্তি 'মাদক সম্রাট'। কিন্তু পরিবর্তন ডটকমের কাছে নিহতের স্ত্রী কাজী শাহেনা বলছেন, তার স্বামী ইউনুছ মিয়া কাঠ ব্যবসায়ী ছিলেন। মাদকের ব্যবসা তিনি করতেন না।

বরং উল্টো পুলিশ তার কাছে প্রায়ই চাঁদা দাবি করত। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পুলিশ। পরে পুলিশ মাদক ব্যবসার অভিযোগ এনে বাড়িতে আমাদের হয়রানি ও নির্যাতন করে। নির্যাতনের ঘটনায় শাহেনা আদালতে মামলা করেন। মামলা তুলে নিতে পুলিশ তার স্বামীকে হুমকি দিত। হুমকিতে কাজ না হওয়ায় মাদক ব্যবসার অভিযোগ সাজিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

শাহেনার দাবি পক্ষে চার মাস আগের পত্রিকা রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। গত ১২ আগস্ট দৈনিক মানবজমিনের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো, "চুনারুঘাটে ৫ পুলিশের বিরুদ্ধে গৃহবধূর মামলা"। ইউনুছ মিয়া যে পুলিশ কর্মকর্তার (এসআই দেলোয়ার হোসেন) গুলিতে মারা গেছেন তিনিসহ আরও চারজনের বিরুদ্ধে শাহেনা মামলা করেছিলেন।
হবিগঞ্জ সমাচারে চার মাস আগের সংবাদ
৮ আগস্ট হবিগঞ্জের স্থানীয় পত্রিকা 'হবিগঞ্জ সমাচার'-এ পুলিশের হাতে নির্যাতিত শাহেনার ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়

কালের কণ্ঠের রিপোর্টার যদি পুলিশের ভাষ্যের পাশাপাশি নিহতের স্ত্রীর বক্তব্য নিতেন তাহলে তিনি এসব তথ্য জানতে পারতেন। পুলিশ ও নিহতের পরিবারের বক্তব্য পাশাপাশি থাকলে পাঠকের কাছে মূল ঘটনা স্পষ্ট হতো। পুলিশ তাকে 'মাদক সম্রাট' বলেছে, তা রিপোর্টে থাকবে। আবার শাহেনা তার পক্ষ থেকে যেসব তথ্য/বক্তব্য দিতে সেগুলোও থাকবে। ঘটনার দুইপক্ষের বক্তব্য মিলেই একজন সাংবাদিকের রিপোর্ট তৈরি হবে- এটা সাংবাদিকতার মৌলিক শর্ত। কিন্তু কালের কণ্ঠ এই শর্তটি মানেনি।

শুধু কি কালের কণ্ঠ? না। উপরে উল্লেখ করা প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, বিডিনিউজ, বাংলানিউজ, জাগোনিউজ, বাংলাট্রিবিউন, এনটিভি অনলাইন, যুগান্তর, মানবজমিন- কেউই ইউনুছ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার স্বজন বা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কারো বক্তব্য নেয়নি; সবাই শুধু পুলিশের ভাষ্য দিয়েই সংবাদ তৈরি করেছে। পরেও এর ফলোআপ কোনো প্রতিবেদন করেনি।

এই পত্রিকাগুলোর পরস্পরের রিপোর্টের মধ্য একটা বিষয় লক্ষ্য করা গেছে- কেউ পুলিশের ভাষ্যকে পাঠকের সামনে জোরালোভাবে হাজির করেছে। যেমন কালের কণ্ঠ, জাগোনিউজ, বাংলানিউজ, এনটিভি অনলাইন। এনটিভি অনলাইনের শিরোনাম "পুলিশের অভিযানে হামলা, গুলিতে সাবেক পৌর কাউন্সিলর নিহত"। শিরোনাম এবং ইন্ট্রো এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে পাঠকের কাছে নিহতের 'অপরাধ' পরিস্কার হয়। আবার এটাও স্পষ্ট হয় যে, তাকে 'হত্যা করতে পুলিশ বাধ্য হয়েছিল'।

পুলিশের বক্তব্যে গরমিল:

এখন দেখবো ওই দিনের ঘটনা নিয়ে পুলিশ কোনো পত্রিকাকে কী বলেছিলো। এবং সেসব বক্তব্য ও তথ্যে কতটা গরমিল আছে।
বাসস এর রিপোর্ট
সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস জানাচ্ছে, "চুনারুঘাট থানার ওসি আজমীর হোসেন জানান, রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে দ্বি-মাগুরুন্ডা গ্রামের এক মহিলা থানায় অভিযোগ নিয়ে আসে তার ছেলেকে ইজিবাইকে জোর পূর্বক মাদক পরিবহনের জন্য চাপ দিচ্ছে মাদক বিক্রেতারা। পরে থানার এসআই আতাউর রহমান মহিলাকে এগিয়ে দিতে যান। তিনি দ্বি-মাগুরুন্ড এলাকায় গেলে কয়েকজন মাদক বিক্রেতা ইয়াবা সেবনরত অবস্থায় তাকে দেখতে পান। মাদক বিক্রেতা ইউনুছ আলী পুলিশকে দেখে মনে করে তাকে ধরার জন্য পুলিশ এসেছে। সে তার হাতে থাকা ক্ষুর দিয়ে এসআই আতাউর রহমানকে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকে। পরে এসআই আতাউর রহমান তার কোমড়ে থাকা রিভলবার বের করে আত্মরক্ষার জন্য ৩ রাউন্ড গুলি করলে সে গুরুতর আহত হয়। পরে আহত অবস্থায় তাকে চুনারুঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হলে সেখানেই রাত পৌনে ১২টায় সে মারা যায়।"
এনটিভি অনলাইনের রিপোর্ট
এনটিভি অনলাইন জানাচ্ছে, "চুনারুঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলী আশরাফের ভাষ্য, সাবেক পৌর কাউন্সিলর ইউনুছ আলীর বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলা ও মাদকের মামলা ছিল। তাঁকে ধরতে রোববার রাতে দিমাগুরউণ্ডা গ্রামে অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় মাদকসেবীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়।
তখন পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি চালালে ইউনুছ আলী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনাস্থল থেকে চার মাদকসেবীকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় এসআই আতাউর রহমান, কনস্টেবল মনীন্দ্র চাকমা ও কনস্টেবল হামিদুল হক আহত হন।"

বাসস'কে ওসি জানালেন, ইউনুছকে ধরতে নয়, এক মহিলাকে এগিয়ে দিতে যান এসআই আতাউর (একা)। পথে ঘটনাচক্রে ইউনুছ ও তার সহযোগীদের মাদক সেবন করতে দেখেন। দেখেও কিন্তু তিনি তাকে ধরতে যাননি। বরং ইউনুছ আগ বাড়িয়ে তার উপর হামলা করে। আর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এনটিভিকে জানালেন, ইউনুছকেই ধরতে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযান চালানো হলে অবশ্যই এসআই আতাউর একা যাওয়ার কথা নয়; ফোর্স নিয়েই গিয়েছেন।

কালের কণ্ঠ জানাচ্ছে, "জানা গেছে, চুনারুঘাট থানার দারোগা আতাউর রহমান কনস্টেবল নিয়ে ওই গ্রামে এক আসামি ধরতে যান। সেখানে একটি ঘরে আসামি আছে সন্দেহে তারা ঢুকে পড়েন। ওই সময় ওই ঘরে ৪ ব্যক্তি মাদক সেবন করছিলেন। তাদের একজন ছিলেন মাদক সম্রাট ইউনুছ মিয়া। তাৎক্ষণিক তিনি একটি ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই দারোগাকে আহত করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় এসআই আতাউর রহমান নিজের পিস্তল থেকে গুলি ছুড়লে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।"

একই ঘটনায় পুলিশের তৃতীয় আরেকটি ভাষ্য দিচ্ছে কালের কণ্ঠ! ইউনুছকে ধরতে অভিযান চালানো হয়নি। অভিযান হয়েছে 'একজন' আসামিকে ধরতে। ঘটনাচক্রে তাদের মধ্যে ইউনুছ ছিলেন। আবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা 'মাদকসেবী'র সংখ্যা নিয়েও আছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। এনটিভি বলছে, ইউনুছ মারা যাওয়ার পর সেখান থেকে ৪ জনকে আটক করা হয়। কালের কণ্ঠ জানাচ্ছে, ইউনুছসহ ৪ জন মাকদ সেবন করছিলেন।

জাগোনিউজ জানাচ্ছে, "পুলিশ জানায়, রাতে চুনারুঘাট থানার দারোগা আতাউর রহমান কনস্টেবল নিয়ে ওই গ্রামে এক আসামি ধরতে যান। সেখানে একটি ঘরে আসামি আছে সন্দেহে তারা ঢুকে পড়েন। ওই সময় ওই ঘরে ৪ ব্যক্তি মাদক সেবন করছিলেন। তাদের একজন ছিলেন মাদক সম্রাট ইউনুছ মিয়া। তার ধারণা হয় পুলিশ হয়তো তাকে ধরতে এসেছে। তাৎক্ষণিক তিনি একটি ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওই দারোগাকে আহত করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।
এসময় এসআই আতাউর রহমান নিজের পিস্তল থেকে গুলি ছুড়লে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। খবর পেয়ে চুনারুঘাট থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে।"

জাগোনিউজ, বাংলাট্রিবিউন, এনটিভি, কালের কণ্ঠ, পরিবর্ত ডটকম জানাচ্ছে, ঘটনাস্থলেই ইউনুছ মারা যান। এবং পুলিশ সেখান থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে। কিন্তু বাসস ও বিডিনিউজ জানাচ্ছে, আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানেই তিনি মারা যান!

বিচারহির্ভূত হত্যা, যেটিকে বাংলাদেশে 'বন্দুকযুদ্ধ', 'ক্রসফায়ার' বা 'পুলিশের গুলিতে নিহত' ইত্যাদি নানাভাবে চিত্রায়িত করা হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, এই ধরনের হত্যা মানবাধিকারের চরমতম লঙ্ঘনের একটি। বিগত ২০০৪ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড চলছে, এবং এর হার বছরে বছরে বেড়েই চলেছে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা এসব হত্যাকাণ্ডের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দেয়া ভাষ্যকে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ করে থাকে। এবং কোনো কোনো ঘটনায় পুলিশের বক্তব্য মিথ্যা বলে প্রমাণিতও হয়েছে। এমতাবস্থায় বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে রিপোর্ট তৈরির সময় সাংবাদিকদেরকে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকার কথা। কিন্তু তা মোটেও হচ্ছে না; যার একটি জলন্ত উদাহরণ হতে পারে চুনারুঘাটের সাবেক কাউন্সিলর ইউনুছের হত্যাকাণ্ড।

এটা এখনো নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে, ইউনুছ মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন না। কিম্বা অন্য কোনো অপরাধে জড়িত ছিলেন না। এটাও নিশ্চিত করে বলার উপায় নাই যে, তার স্ত্রী শাহেনা যা বলেছেন সবই সত্য। তাদের অনেক কথা মিথ্যা হতেই পারে। ঠিক যেমনটি মিথ্যা হতে পারে পুলিশের দেয়া অনেক তথ্য বা বক্তব্যও। বিশেষ করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পুলিশের দেয়া তথ্যে যে ধরনের গরমিল দেখা যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ জাগতেই পারে।

উভয় পক্ষে বক্তব্যের সঠিকতা যাচাইয়ের উত্তম মাধ্যম হলো আদালত। সেখানে গিয়ে কোনো মীমাংসার আগ পর্যন্ত (এবং পর পর্যন্তও!) সাংবাদিকদের দায়িত্ব হলো ঘটনার উভয় পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরতে হবে। বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে ঘটনার সব দিক তুলে ধরতে সাংবাদিকদেরকে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবেই হবে।

যদি সাংবাদিকরা তাদের এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, আর কোনো নিরপরাধ মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন (প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের হত্যার শিকার ব্যক্তিটি সত্যিকারের অপরাধী হলেও এক্ষেত্রে সে ভিকটিম), তাহলে ভিকটিমের কণ্ঠকে চেপে ধরার দায়ে খুনে ভাগিদার যে সাংবাদিকরাও হবেন, তা একটি নাবালক শিশুও বলবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন