শুক্রবার, মে ১১, ২০১৮

স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ: বড় বড় পত্রিকায় মনগড়া খবর, ভুয়া ছবি



কদরুদ্দীন শিশির

গতকাল ১০ মে দিনব্যাপী বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম জগতে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি ছিল ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সম্ভাব্য উৎক্ষেপণ’। আর আজ ১১ মে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ নিয়ে আজকের জাতীয় পত্রিকাগুলোর পরিবেশিত বিভ্রান্তিকর খবর ও ভুয়া ছবি প্রসঙ্গ!

কোনো এক কারণে বৃহস্পতিবার দিবাগত ভোর ৩টা ৪৭ মিনিটে পূর্ব নির্ধারিত উৎক্ষেপণ থেকে সরে আসে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে মহাকাশে পাঠানোর দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম ও কিছু পত্রিকার নগর সংস্করণেও আজ শুক্রবার খবর ছাপা হয়, স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।

নিচে আমরা উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পত্রিকার ইপেপারের স্ক্রিনশট বা মোবাইলে তোলা ছবি তুলে দিচ্ছি--

সমকাল:

সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর কভারেজ ছিল দৈনিক সমকালের। পত্রিকাটি প্রথম সংস্করণে ৬ কলাম রঙ্গিন শিরোনাম করেছে “মহাকাশে জয়যাত্রা”। নিচে হ্যাঙ্গার হিসেবে দিয়েছে “বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ”।

প্রতিবেদনটির ইন্ট্রো লেখা হয়েছে এভাবে-- “বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের স্লোগান ছিল 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু'। সেই স্লোগান বুকে নিয়েই মহাকাশের পথে উড়ল দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। বাঙালির মুক্তির স্লোগান এখন তরঙ্গায়িত হচ্ছে সুদূরের অন্তরীক্ষে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এ রিপোর্ট যখন লেখা হচ্ছিল, তখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-কে নিয়ে উৎক্ষেপণ যান ফ্যালকন-৯ ওড়ার চূড়ান্ত মুহূর্তে। চলছিল শেষ মুহূর্তের ক্ষণগণনা। পুরো উৎক্ষেপণটি সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিভিন্ন জেলা শহরে বড় পর্দায় সেটা প্রদর্শনেরও ব্যবস্থা করা হয়। শুধু শহর নয়, উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। ঐতিহাসিক এ মুহূর্তের সাক্ষী হতে অসংখ্য বাঙালি গত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছেন।”

লক্ষণীয় শব্দ/বাক্যগুলো হচ্ছে, ‘মহাকাশে উড়লো’, ‘বাঙালির মুক্তির স্লোগান এখন তরঙ্গায়িত হচ্ছে সুদূরের অন্তরীক্ষে’, ‘পুরো উৎক্ষেপণটি সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশন’!

সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, ভুয়া ছবি ব্যবহার করেছে সমকাল। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একটি রকেট ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র উড্ডয়ন করে আকাশ অভিমুখে যাত্রা করছে। অথচ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট তখনও টায় দাঁড়িয়ে ছিল লঞ্চ প্যাডে!



এ তো গেল প্রথম সংস্করণে দেয়া ভুল তথ্য ও ভুয়া ছবির কথা। নগর সংস্করণে এসে শিরোনাম পরিবর্তন করে পত্রিকাটি। ‘মহাকাশযাত্রা বিলম্বিত’। ইন্ট্রোও বদলে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু প্রথম সংস্করণে উড্ডয়নরত রকেটের যে ভুয়া ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল সেটিই দ্বিতীয় সংস্করণে ছাপানো হয়েছে (অনলাইনে প্রথম সংস্করণে রিপোর্টটিকে এডিট করে দ্বিতীয় সংস্করণে যেটি ছাপা হয়েছে সেটি আপলোড করা হয়েছে)। সাথে প্রথম সংস্করণে ক্যাপশনটিও পরিবর্তন করা হয়নি- “ফ্যালক ৯-এ চড়ে বৃহস্পতিবার রাতে মহাকাশে পাড়ি জমায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট”। নিচে দেখুন সমকালের দ্বিতীয়স সংস্করণের শিরোনাম-ছবি ও ক্যাপশন।

দ্বিতীয় সংস্করণে ছবিটির ক্যাপশন বদলে দিয়ে যদি উল্লেখ করা হতো যে, এটি একটি ফাইল ছবি তাহলে, সেটিকে ‘ভুয়া ছবি’ বলার সুযোগ ছিল না।


ইনকিলাব:

সমকালের মতো ভুল তথ্য ও ভুয়া ছবি ব্যবহার করেছে দৈনিক ইনকিলাব। পত্রিকাটিতে অবশ্য প্রধান শিরোনাম ছিল না খবরটি। প্রথম পাতায় ডাবল কলামে শিরোনাম হচ্ছে, “মহাকাশে ছুটছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট”

ইন্ট্রোতে লেখা হয়েছে, “মহাকাশে কক্ষপথের দিকে ছুঁটছে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’ ফ্লোরিডার স্থানীয় সময় ১০ মে বিকাল ৪টা ১২ মিনিট থেকে ৬টা ২২ মিনিটের মধ্যে বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত (১১ মে) রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিট কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চ প্যাড থেকে স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের বিশেষ এই মুহূর্ত দেখতে এবং ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে থাকতে অনেকেই চোখ রেখেছিলেন টেলিভিশন ও অনলাইনের পর্দায়।”

ইনকিলাব আরেক ধাপ এগিয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যানের একটি উদ্ধৃতি বানিয়ে প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটির রিপোর্টে লেখা হয়েছে-- “ফ্লোরিডা থেকে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসির চেয়ারম্যান শাহজাহান বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট বাংলায় ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’- স্লোগান নিয়ে মহাকাশে কক্ষপথের দিকে ছুটছে। এর আগে উৎক্ষেপণের জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের প্রায় সব ধরণের পরীক্ষা সম্পূর্ণ হয় বলেও জানান তিনি।”

যেখানে উৎক্ষেপণই হয়নি, সেখানে স্লোগান নিয়ে ছুটে কিভাবে?!


বাংলাদেশ প্রতিদিন:

বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রধান শিরোনাম করে, “মহাকাশে এখন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ”। অনলাইন থেকে রিপোর্টটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে গুগল ক্যাশে-তে পড়তে এখানে ক্লিক করুন

গোলমেলে রিপোর্টটির কোথাও বলা হয়েছে ‘উৎক্ষেপণ করেছে’ আবার কোথাও বলা হয়েছে, “শুরুতে প্রচণ্ড গতিতে রকেটটি আকাশের দিকে ছুটে যাওয়ার সময় আগুনের গোলা দেখা যাওয়ার কথা রয়েছে।” (অর্থাৎ উৎক্ষেপণ হয়েছে কিনা রিপোর্টার নিশ্চিত নন)।


ইন্ট্রো তুলে ধরা হল-- “মহাকাশে যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্বাপ্নিক এক ইতিহাস গড়ল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে উৎক্ষেপণের সময়সূচি ছিল নির্ধারিত। সবকিছু ঠিক থাকলে ১০ দিন পর মহাকাশের নির্ধারিত ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের কক্ষপথে পৌঁছবে বাংলাদেশের অহংকারের প্রতীক বঙ্গবন্ধু-১।”

রিপোর্টের অন্যত্র লেখা দুটি বাক্য হচ্ছে এরকম-- “উৎক্ষপণের মুহূর্তটি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ দেশের সব কটি বেসরকারি টেলিভিশন।” “এ ছাড়া উৎক্ষেপণস্থল থেকে ৬ দশমিক ২৭ কিলোমিটার দূরত্বের অ্যাপোলো সেন্টার থেকেও উৎক্ষেপণ দেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা বাংলাদেশিরা।”

আর যে ছবিটি ব্যবহার করেছে ইনকিলাব সেটিতে ফটোশপে করে ভুল বানানে ‘Bangobandhu-1’ লেখা রয়েছে। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে সরকারদলীয় কিছু ব্যক্তি এই ছবিটি প্রচার করে দাবি করেছিলেন, এটিই ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’ এর ছবি। বাস্তবে এটি স্যাটেলাইট নয়, বরং স্যাটেলাইটকে বহনকারী রকেট ফ্যালকন-৯ এর ছবি!  



দ্বিতীয় সংস্করণে শিরোনাম বদলে দিয়েছে বাংলাদেশ প্রতিদিন, “অপেক্ষা আরও বাড়ল”।


যুগান্তর:

যুগান্তর প্রথম সংস্করণের পর নগর সংস্করণেও শিরোনাম রেখেছে “বাংলাদেশের মহাকাশ জয়”। শুক্রবার রাত ১১টা পর্যন্ত অনলাইনেও রিপোর্টটি বহাল তবিয়তে ছিল। ইন্ট্রোতে লেখা হয়েছে, “এবার মহাকাশে আঁকা হল বাংলাদেশের নাম। পাঠক হিসেবে এ সংবাদটি যখন পড়ছেন, বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ ততক্ষণে ছুটে চলার কথা কক্ষপথের দিকে।”



জনকণ্ঠ:

উভয় সংস্করণে জনকণ্ঠের শিরোনাম ছিলো “এবার মহাকাশে পা”। ইন্ট্রোতে বলা হয়েছে, “আরও একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। এর মাধ্যমে মহাকাশে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোরে স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করার কথা।”


কালের কণ্ঠ:

৮ কলামে ব্যানার হেডলাইন করা প্রথম সংস্করণে প্রকাশিত “বাংলাদেশের নাম মহাকাশে” শিরোনামের প্রতিবেদনটি অনলাইন থেকে সরিয়ে ফেলেছে কালের কণ্ঠ। তবে পরের সংস্করণে শিরোনাম একই রেখে ভেতরে তথ্য বদলে নতুন করে অনলাইনে আপলোড করা হয়েছে প্রতিবেদনটি। 

মডিফাই করা রিপোর্টটির প্রথম দুই প্যারা ছিল এরকম “স্যাটেলাইট যুগে বাংলাদেশ! মহাকাশে বাংলাদেশ!! তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্বমর্যাদায় বাংলাদেশ!!! সাহসী সিদ্ধান্ত ও দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর অবশেষে মহাকাশে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম যোগাযোগ ও সম্প্রচার স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান লেখা স্যাটেলাইটটি গত রাতে মহাকাশে উৎক্ষেপণের সব আয়োজন করা হলেও আবহাওয়ার কারণে মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা বাড়ল আজ শুক্রবার পর্যন্ত। স্যাটেলাইটটি আজ রাতে উৎক্ষেপণের মাধ্যমে স্যাটেলাইট অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার কথা রয়েছে বাংলাদেশের।”


যায়যায়দিন:

এই পত্রিকার প্রধান শিরোনামের রিপোর্টটি ছিল “মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট”।



নয়াদিগন্ত:

“মহাকাশে বাংলাদেশ” শিরোনামের প্রধান শিরোনামের সাথে হ্যাঙ্গার হিসেবে নয়াদিগন্ত যুক্ত করেছে “স্যাটেলাইট ক্লাবে প্রবেশ”



ভোরের কাগজ:


“মহাকাশে বাংলাদেশ” শিরোনামের সংবাদে কাল্পনিক বর্ণনার আশ্রয় নিলেও শেষ পর্যন্ত অন্তত পাঠককে ভুয়া তথ্য দেয়নি ভোরের কাগজ। পত্রিকাটির রিপোর্টার “রকেট ফ্যালকন-৯ এ চেপে শব্দের চেয়ে দ্রুতগতিতে মহাকাশে ছুটে চলেছে বাংলাদেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। ....।”

বেশ কয়েক লাইনে একটি দৃশ্যকল্প তৈরি করার পর বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণকে কেন্দ্র করে মূলত এটি একটি কল্পদৃশ্য। তবে পাঠকের হাতে যখন পত্রিকাটি পৌঁছেছে, ততক্ষণে তা হয়তো বাস্তবে রূপ নিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ২টা ১২ মিনিট থেকে ৪টা ২২ মিনিটের মধ্যে এ স্যাটেলাইটের মহাকাশে পাড়ি জমানোর কথা।”

এতে পাঠক উড্ডয়নের একটি দৃশ্য কল্পনায় ফুটিয়ে তুললেও পরে জানতে পেরেছেন যে, এটি কোনো নিশ্চিত তথ্য নয়।

ভোরের কাগজের রিপোর্টে প্রথম অংশটুকু এখানে পড়তে পারেন--

মানবজমিন:

এই পত্রিকাটি প্রধান শিরোনাম করেছে “মহাকাশে বাংলাদেশ”।  তবে ভেতরে নয়াদিগন্ত এবং মানবজমিন সরাসরি ‘উৎক্ষেপণ হয়েছে’ বলেনি।

প্রথম আলো:

প্রথম আলোর শিরোনামে বা রিপোর্টের ভেতরে সরাসরি ‘উৎক্ষেপণ হয়েছে’ বলা হয়নি। পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ভাঁজের নিচে শিরোনাম ছিলো ‘মহাকাশের পথে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’।



এক ছবিতে কয়েকটি পত্রিকার আজকের কভারেজ-



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন