বুধবার, জুন ০১, ২০১৬

রানা আইয়ুবের ‘গুজরাট ফাইলস’ ও ভারত-বাংলাদেশের মিডিয়া


কদরুদ্দীন শিশির

রানা আইয়ুব- নামটির সাথে হয়তো অনেকে ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়ে গেছেন। অবশ্য না হওয়ারও ‘যৌক্তিক’ কারণ আছে। যাইহোক, প্রথমে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক।


বাংলাদেশিদের কাছে এই নাম এবং ব্যক্তি- দুটো একসাথে মিলে কিছুটা ধাঁধা তৈরি করতে পারে! ‘রানা’ এবং ‘আইয়ুব’ আমাদের কাছে পুরুষের নাম হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু ভারতীয় নাগরিক রানা আইয়ুব একজন নারী। বয়সের কোটায় মাত্র তিরিশ পেরিয়েছেন এই সুদর্শনা ও দুঃসাহসী সাংবাদিক।

১৯৮৩ সালে জন্ম কাশ্মীরের শ্রীনগরে। বড় হয়েছেন ‘ভূস্বর্গে’ই। স্কুল জীবন শেষে ভর্তি হন জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামিয়ায়। ওখানে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করেছেন ‘সোশ্যাল কমিউনিকেশনস এন্ড মিডিয়া’ নিয়ে।

তারপর সাংবাদিকতায় আসা। যোগ্যতা-বলে দ্রুতই পরিচিতি পেয়েছেন এখানে। অনুসন্ধানি সাংবাদিকতায় জবরদস্ত আগ্রহী রানা এক পর্যায়ে যোগ দেন ভারতের বাম ঘরানার নামকরা পত্রিকা ‘তেহেলকা’য়। ২০১৩ সালে নভেম্বরে পদত্যাগের আগ পর্যন্ত দারুণ কিছু কাজ করেছেন সেখানে।

স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১১ সালে ‘সংস্কৃতি’ অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ভারতে সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করা শীর্ষ স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ‘মুসলিম মিরর’ ২০১৬ সালে তাকে বর্ষসেরা সাংবাদিক অ্যাওয়ার্ড প্রদান করে। এর আগে ২০১০ সালে ‘দেশভাগের পর ভারতের শীর্ষ প্রভাবশালী ৫০ মুসলিম’ এর তালিকায়ও স্থান পায় তার নাম।

আউটলুক ম্যাগাজিন বিশ্বের সেরা ২০টি ম্যাগাজিন রির্পোটের যে তালিকা করেছিল তাতে রানা আইয়ুবের একটা রির্পোটও নির্বাচিত হয়েছিল। তেহেলকা ছাড়ার পর বর্তমানে ভারতের এনডিটিভি এবং আউটলুক ম্যাগাজিনে রাজনীতি বিষয়ক কলাম লেখা আর পাশাপাশি ফ্রীল্যান্স সাংবাদিকতা করেন।

বিজেপি ও মোদির আতঙ্ক রানা আইয়ুব:

ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি কাছে বেশ আগে থেকেই রানা আইয়ুব যেন এক মূর্তিমান আতংক! অমিত শাহ বিজেপির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৪ সালের ৯ জুলাই ‘a new low in Indian politics’ শিরোনামে খ্যাতনামা অনলাইন সংবাদমাধ্যম ডিএনএ-তে একটি প্রবন্ধ লেখেন রানা আইয়ুব। সেখানে নানা অপরাধ, বিশেষ করে উগ্রবাদীদের সাথে অমিতের সংশ্লিষ্টতা তুলে ধরেন তিনি। কিন্তু প্রকাশের এক ঘন্টার মধ্যে বিজেপির চাপে রানার সেই লেখাটি সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয় ডিএনএ। অবশ্য বর্তমানে রানাকে ঘিরে বিজেপি, এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আতঙ্ক আরেক দফা বাড়লো!

গত শুক্রবার (২৫ মে) আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লিতে প্রকাশিত হলো রানার প্রথম বই ‍“গুজরাট ফাইলস: অ্যানাটমি অব অ্যা কাভার আপ” (Gujarat Files: Anatomy of a cover up)। এটি ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যা নিয়ে তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য ও বক্তব্যের একটি সংকলন।

দুঃসাহসী ও চরম ঝুঁকিপূল সেই অনুসন্ধানের পুরোটা সময় রানা থেকেছেন নিজের পরিচয় গোপন করে। গ্রহণ করেছিলেন ‘মৈথিলী থিয়াগি’ ছদ্মনাম। আমেরিকার ফিল্ম ইনস্টিটিউটে কর্মরত ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালকের ছদ্ম-পরিচয়কে নিজের সুবিধার জন্য ব্যবহার করেন রানা। যিনি কিনা আবার সেজেছিলেন আরএসএস সমর্থকও! ২৬ বছরের এক তরুণীর দুঃসাহসিকতায় মুগ্ধ লেখক সলীল ত্রিপাথি লিখেছেন, “নিজের মুসলিম পরিচয় গোপন করে একটি হিন্দু নাম নিয়ে একইসাথে দুটি ভিন্ন জীবন যাপন করে অনুসন্ধানের দায়িত্ব নেয়া সত্যিই আইয়ুবের দারুণ সাহসের পরিচায়ক।”

রানা অনুসন্ধান চালান মূলত গুজরাটের নীতিনির্ধারক মহলের অনেকের সাথে ধারাবাহিক আলাপচারিতার মাধ্যমে। ২০০১ থেকে ২০১০ পর্যন্ত গুজরাটে দায়িত্ব পালন করা রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিবিড় ওইসব আলাপচারিতায় তাঁরা গুজরাটে পদ্ধতিগত গনহত্যার বিবরণ দিয়েছেন ‘মেথিলী’র কাছে। বিশেষ করে তখনকার মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদির কিছু সিদ্ধান্ত যে গণহত্যার জন্য দায়ী তা উঠে এসেছে গুজরাট ফাইলসে। এসব তথ্য রানাকে জানিয়েছেন প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরাই। গণহত্যার দায় মোদির ওপর ভর্তে এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ দাঁড় করিয়েছেন রানা। তার কাছে গোপনে রেকডকৃত মোদির অন্তরঙ্গ আলাপচারিতাও রয়েছে।

ভারতীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘুরা কেমন বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকেন এসবের বর্ণনা গুজরাট ফাইলসে উঠে এসেছে কর্মকর্তাদের অনেকের মুখেই। সরকার, প্রশাসন এমনকি বিচারবিভাগের উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গের অনেকের মধ্যে কী পরিমাণ সাম্প্রদায়িক মানসিকতা বিরাজ করে তারও কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে বইটিতে। এমন একটি উদাহরণ হচ্ছে একজন সিনিয়র বিচারকের মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য। তিনি গণহত্যার বিষয়ে বলছিলেন, ‘এই মুসলমানরা কখনো বদলাবে না। তাদের প্রতি এমনটা ঘটার (গণহত্যা) বিকল্প ছিল না।’

আবার অনেক কর্মকর্তা গণহত্যার ঘটনায় তাদের করার কিছুই ছিল না বলে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন রানার কাছে।

বইটিতে সবচেয়ে বাজেভাবে ফুটে উঠেছে তখন বেছে বেছে বেশ কিছু মুসলিম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে পুলিশি এনকাউন্টারে হত্যার বর্ণনা। সিনিয়র পুলিশ কর্তারা এসব নিয়ে এমনভাবে কথা বলেছেন যেন তা খুবই স্বাভাবিক ছিল! এ ধরনের হত্যার আইনি জঠিলতার বিষয়ে সজাগ থাকলেও তারা সেটিকে (হত্যা) নিজের কাজের অংশ হিসেবেই নিয়েছিলেন। নৃশংস ওইসব ঘটনায় কোনো অনুশোচনা নেই তাদের।

রানার কাজ নিয়ে ইতোমধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। মোদির দল বিজেপি-আরএসএস এর কর্মীরা তার বিরুদ্ধে প্রচারণা শুরু করেছে। পক্ষে এখনো তেমন কোনো জোরালো বক্তব্য আসেনি কারো। যদিও প্রকাশনা অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন বিখ্যাত লেখক অরুন্ধতী রায়সহ ভারতের অনেক গণমাণ্য ব্যক্তিবর্গ। তবে দুঃসাহসিক অনুসন্ধানের প্রশংসা করছেন অনেকেই। তেহেলকায় রানার সাবেক সম্পাদক সোমা চৌধুরী ৩১ মে এক প্রতিক্রিয়ায় তার কাজের প্রশংসা করেন। পাশাপাশি রানার রিপোর্ট তেহেলকায় না ছাপানোর পেছনে ‘রাজনৈতিক চাপ’ থাকার অভিযোগ সঠিক নয় বলেও দাবি করেছেন সোমা।

অবশ্য গুজরাট ফাইলস প্রকাশের পর ‘স্টিং অপারেশনে’ এবং সাংবাদিকতার নৈতিকতা আবারো আলোচনায় এসেছে। অনেকে সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এমন গুপ্তচরগিরির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রে ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’:

রানা আইয়ুব ২০১০ সালে তার গুজরাট ‘স্টিং অপারেশন’ (পরিচয় গোপন করে অপরাধ তদন্ত) শুরু করেছিলেন তেহেলকা ম্যাগাজিনের হয়েই। কিন্তু যখন তিনি ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন তথ্য হাতে পান তখন ‘চাপের কথা’ বলে সেসব প্রকাশে অস্বীকৃতি জানায় তেহেলকা কর্তৃপক্ষ।

এরপর আরো একাধিক সংবাদমাধ্যমে তিনি তার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য প্রকাশে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেন রিপোর্ট আকারে যেহেতু প্রকাশ করতে কেউ রাজি হচ্ছে না, তাহলে বই হিসেবেই প্রকাশ করা যাক। অতপর এবার প্রকাশদের পেছনে দৌড়ালেন কিছুদিন। নাহ! ভারতের কোনো প্রকাশকই রাজি হয়নি রানার গুজরাট গণহত্যা সংক্রান্ত অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বই প্রকাশ করতে। কেউ উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের প্রিয় বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী ন.মো’কে ঘাঁটাতে চাননি। শেষমেশ রানা আইয়ুব সিদ্ধান্ত নেন নিজেই বইটি প্রকাশ করবেন। এবং সে অনুযায়ী গত ২৫ মে দিল্লীতে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন।

লক্ষ্যণীয় হল, অনুসন্ধান নিয়ে রিপোর্ট এবং বই প্রকাশের ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলা রানাকে এখনো প্রত্যাখ্যান করে চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে ‘বড় গণতন্ত্র’ ভারতের মিডিয়া। প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে বিক্রিতে প্রতিষ্ঠান অ্যামাজনের ওয়েবসাইটে বেস্টসেলার তালিকায় দ্বিতীয়তে থাকা বইটি নিয়ে সাংবাদিক একদম চুপ। যদিও গুজরাট ফাইলসকে ‘দেশবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে অনলাইনে ক্যাম্পেইন করে ঝড় তুলছে আরএসএস-সহ অন্যান্য হিন্দুত্ববাদী উগপন্থীরা।

ভারতেরই একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ২৮ মে রানার প্রতি মিডিয়ার আচরণ নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। “Why Media Blacked Out Rana Ayyub And Her Incisive Book On Gujarat Riots?
  শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে প্রকাশনা অনুষ্ঠানটিকেও ‘বয়কট’ করেছেন সাংবাদিকরা। আবার অনেকে সাংবাদিক তাতে উপস্থিত থাকলেও সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম কোনো প্রতিবেদন ছাপায়নি রানা আইয়ুব বা তার গুজরাট ফাইলস নিয়ে। মূলধারার সংবাদামাধ্যমগুলোর মধ্যে একমাত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সংবাদ ছাপিয়েছে রানাকে নিয়ে। ‘বুক রিভিউ’ হিসেবে ওয়্যার এবং লাইভমিন্ট নামক দুটি ওয়েবসাইটে প্রতিবেদন এসেছে। এর বাইরে হাতে গোনা তিন/চারটি ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

ভারতজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার ইস্যু হওয়ার মতন এমন একটি ঘটনা নিয়ে মূলধারার মিডিয়া কেন নীরব- এমন প্রশ্নের জবাবে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া ইন্ডিয়া টুডে’র কনসাল্টিং এডিটর রাজদীপ সরদেশাই বলেন, ‘হয়তোবা কোনো মিডিয়া হাউজই এটা চায় না যে উপরের স্তরের রাজনীতিবিদদের সাথে তাদের যে সদ্ভাব আছে তা নষ্ট হয়ে যাক।’

মজার বিষয় হল শুধু ভারতে নয়, রানা আইয়ুবকে ‘ব্লাকআউট’ করার একই চিত্র ‘মোদিদপুষ্ট’ সরকারের অধীনে চলা বাংলাদেশের মিডিয়ায়ও বিদ্যমান! প্রকাশনা অনুষ্ঠানের এক সপ্তাহ পরও বাংলাদেশি কোনো পত্রিকা একটি লাইনও ছাপা হয়নি দুঃসাহসী এই নারী সাংবাদিকের কাজ নিয়ে। অথচ, ‘বলিউডের নারীদের’ নিয়ে গরম গরম প্রতিবেদন নিয়ে প্রতিদিন মুখর থাকে এখানকার পত্রিকা/টিভিগুলো। আবার বিশ্বজুড়ে ‘নারীর এগিয়ে যাওয়া’র নানান নজির এদেশীয় সংবাদমাধ্যমেপ্রায়ই ছাপা হয় ‘অনুপ্রেরণা’ আকারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, রানা আইয়ুবে বাংলাদেশি নারী সাংবাদিকদের জন্য সামান্যতম ‘অনুপ্রেরণা’র ছিটেফুটোও গত এক সপ্তায় খুঁজে বের করতে পারলেন না এখানকার মিডিয়া কর্তারা!  

সবকিছু বাদ দিলেও, একটি গণহত্যায় একজন ব্যক্তির দায়-দায়িত্ব প্রমাণিত হয়- এমন ডকুমেন্টেড তথ্য-উপাত্ত হাতে পেয়ে যখন কোনো গণমাধ্যম একেবারে ভাবলেশহীন হয়ে বসে থাকতে পারে তখন তাকে কী বলে অভিহিত করা যেতে পারে? ভীত? সেলফ সেন্সরড? বায়াস? নাহ, এসব শব্দ মিডিয়ার এমন ‘অসুস্থ্যকর’ নীরবতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে না।

৮টি মন্তব্য:

  1. ধন্যবাদ এই বিষয় নিয়ে লেখার জন্যে।

    উত্তরমুছুন
  2. এই লেখার মাধ্যমেই বিশ্ববাসী রানার অসাধারণ কাজের বিষয়ে জানবে.....

    উত্তরমুছুন
  3. ভালো লেগেছে লেখাটা। ধন্যবাদ আপনাকে।

    উত্তরমুছুন
  4. কলমকে চমৎকার ভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
    এগিয়ে যাক পথচলা।
    অসংখ্য ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  5. ভালো লেখার জন্য শুভকামনা রইল ।

    উত্তরমুছুন