বৃহস্পতিবার, জুন ০৯, ২০১৬

বিডিনিউজ সম্পাদকের ‘নীতি শিক্ষার ক্লাস’ ও তার পত্রিকায় নীতিচর্চা: একটি প্রামাণ্য পর্যালোচনা

একাত্তর টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে বিডিনিউজ এর প্রধান সম্পাদক জনাব তৌফিক ইমরোজ খালিদী
কদরুদ্দীন শিশির:
ইসরাইলি এক রহস্যজনক ব্যক্তি মেন্দি এন সাফাদি নিয়ে মাস দেড়েক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি সরগরম। বাংলাদেশে সরকারের মতে, ইসরাইলি নাগরিক এই ব্যক্তির সাথে যোগসাজশ করে তাদেরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায় বিরোধী দল বিএনপি। তারই অংশ হিসেবে গত মার্চ মাসে বিএনপি নেতা আসলাম চৌধুরী ভারতে গিয়ে বৈঠক করেছেন সাফাদির সাথে, যাকে আবার সরকারি ভাষ্য মতে, ‘মোসাদ এজেন্ট’ বলেও প্রচার করা হয়েছিল।


সাফাদি যখন মিডিয়ায় হটকেক তখন বিবিসি বাংলা তাকে নিয়ে একটি সাক্ষাৎকারমূলক একটি বিশেষ রিপোর্ট করে। গত ২৮ মে প্রকাশিত রিপোর্টটির শিরোনাম ছিল “সজীব ওয়াজেদের সাথে `বৈঠক` হয়েছে: সাফাদি”।  ঘটনাপ্রবাহে এটি নতুন মাত্রা যোগ করে। সরকার এবং সরকারের ঘনিষ্ট লোকজনের সমালোচনার লক্ষ্যবস্তেু পরিণত হয় বিবিসি বাংলা। তারা বিবিসির দায়িত্বজ্ঞান এবং নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন এবং ক্ষমা চাওয়ার আহবান জানান।  ০০ (জয়ের স্ট্যাটাসের লিংক)

সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয় সেটি হল বিবিসির রিপোর্টে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে সাফাদির বৈঠক করার দাবি সংক্রান্ত সাফাদির বক্তব্য থাকলেও সে বিষয়ে জয়ের কোনো বক্তব্য ছিল না।

সাংবাদিকতার নৈতিকতায় এটি একটি গুরুতর অন্যায়। কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে অভিযোগ আকারে কিছু প্রকাশ বা প্রচার করার আগে অভিযুক্তের বক্তব্য নেয়া বা সম্ভাব্য সব উপায়ে বক্তব্য নেয়ার চেষ্টা করা রিপোর্টারের কর্তব্য। রিপোর্টার বক্তব্য না নিলে বা প্রমাণযোগ্য যথেষ্ট চেষ্টা না করলে অভিযোগটি সংবাদ আকারে প্রকাশ না করা সম্পাদকের দায়িত্ব। এই দায়িত্বের বরখেলাফ হলে তার দায় রিপোর্টারের মতো সমানভাবে সম্পাদকের উপরও আইনগত এবং নৈতিক উভয় দিক থেকে বর্তায়।

বিবিসি বাংলা তাদের রিপোর্ট জয়ের বক্তব্য ছাড়া প্রকাশ করেছে। তবে রিপোর্টের এক জায়গায় লিখেছে, “তবে তার (সাফাদির) এই দাবির ব্যাপারে মি. ওয়াজেদের বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি।”

উপরিউক্ত লাইনটি থেকে স্পষ্ট নয় যে, চেষ্টা করার পরও জয়ের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি, নাকি চেষ্টাই করা হয়নি। যদি চেষ্টা করা হতো তাহলে বিবিসির উচিত ছিল কি কি মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল- যেমন মোবাইল, অফিসের ফোন, ইমেইল, ফেইসবুক ইনবক্স ইত্যাদি- তা উল্লেখ করা। আন্তর্জাতিক অনেক সংবাদমাধ্যম কোন মাধ্যমে কয়বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে তাও রিপোর্টে উল্লেখ করে দেয়। বিবিসি এমন কিছুই করেনি। ফলে, যদি এমনটা যদি কেউ মনে করে যে, বিবিসি জনাব জয়ের সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টাই করেনি তাহলে এই মনোভাবকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। বিবিসির রিপোর্টের সেই দুর্বলতা আছে।

বিডিনিউজ সম্পাদকের ‘নীতি শিক্ষার ক্লাস’:

৩০ মে রাতে একাত্তর টেলিভিশন জয়-সাফাদি বৈঠক নিয়ে বিবিসির প্রতিবেদন প্রকাশের ঘটনায় একটি আলোচনা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। তাতে আরো দুইজন আলোচকের সাথে ছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদীও।

অনুষ্ঠানে জনাব খালিদী বিবিসির রিপোর্টের উপরোল্লিখিত দুর্বলতাকে হাইলাইট করে ‘সাংবাদিকতায় কিভাবে নৈতিকতা চর্চা করতে হয়’ তার উপর নাতিদীর্ঘ একটি বয়ান পেশ করেন। সেটাকে বিবিসির জন্য খালিদীর ‘নীতি শিক্ষার ক্লাস’ হিসেবে অভিহিত করা যায়।

একাত্তর এর লাইভ অনুষ্ঠানে খালিদী বলেন, “বিবিসির বিষয় ও ভাষাভিত্তিক শত শত আউটলেটের মধ্যে বিবিসি বাংলা অনলাইন একটি। তাদের সবাইকেই বিবিসির ‘এডিটোরিয়াল গাইডলাইন’ মানতে হয়, অনুসরণ করতে হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করার ‘যোগ্যতা’ সবার থাকে না।”

“আমার মনে হয় বড় অপরাধ করেছে বিবিসি বাংলা অনলাইন। তাদের উচিৎ ছিল না এ রকম একটি বিষয় নিয়ে এ রকম স্টোরি করা; এবং তাদের অবশ্যই কথা বলা উচিৎ ছিল সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে।”

পাশাপাশি সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা মেনে নিজে কিভাবে কাজ করছেন তার বিবরণ দিতে গিয়ে জনাব খালিদী বলেন, “আমি এই ক্ষেত্রে একটা কথা বলে রাখতে চাই, পাঁচ বছর আগে যখন নরওয়েজিয়ান টেলিভিশন ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে একটি ফিল্ম করেছিল। আমরা তা নিয়ে রিপোর্ট (কথাটি স্পষ্ট নয়) তৈরি করেছিলাম। করতে গিয়ে আমরা কিন্তু বহুভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। আমি দেখাতে পারবো যে, আমরা কতগুলো ইমেইল করেছি। আমাদের সহকর্মীরা তাদেরকে ফোন করার চেষ্টা করেছেন। তাদের টেক্সট করা হয়েছে। বহুভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে।”

বিবিসি বাংলার কী করা উচিত ছিল, আর কী করা উচিত ছিল না- এ সংক্রান্ত খালিদীর যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে ভুল কিছু নেই। তিনি সঠিক কথাগুলোই বলেছেন। সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যাপারে একটি স্পর্শকাতর (বাংলাদেশি মানুষের পারসেপশন মতে) অভিযোগ, যেটি তার রাজনৈতিক লাভক্ষতির হিসাবের সাথে যুক্ত, তুলে অভিযুক্তের কোনো বক্তব্য ছাড়াই ‘সংবাদ প্রতিবেদন’ আকারে প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতার স্পষ্ট লংঘন।

বিডিনিউজের নীতিচর্চা: একটি প্রামাণ্য পর্যালোচনা:
বিডিনিউজের প্রধান সম্পাদক জনাব তৌফিক ইমরোজ খালিদী তার উপরের বক্তব্যে বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন এক কর্মকতাকে নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে বিবিসি বাংলার নীতিচর্চা না করার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। কিন্তু এখন আমরা দেখবো তিনি এবং তার পত্রিকা একই সরকারের বিভিন্ন বাহিনী কর্তৃক ঘটানো মানবাধিকারের সর্বোচ্চ লংঘনের নানা ঘটনায় ধারাবাহিকভাবে কেমন করে সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছেন।

‘ক্রসফায়ার’ বা কথিত ‌‘বন্দুকযুদ্ধে’ কাউকে (সে যত বড় অভিযুক্তই হোক না কেন) হত্যা করা একটি ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’। মানবাধিকার লংঘনের জাতিসংঘ নির্ধারিত যেসব মানদণ্ড রয়েছে তার মধ্যে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ একদম উপরের দিকে একটি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনকে খুবই গুরুত্বের সাথে কভার করা হয় (যদি কোনো বিশেষ ইসূতে বিশেষ সংবাদমাধ্যমের বিশেষ বায়াস না থাকে)। তার মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যার ক্ষেত্রে সতর্কতা আরো বেশি অবলম্বন করা হয়। এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রান্তের পক্ষের বক্তব্যকে (ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে) আক্রমণকারীর বক্তব্যের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া হয়। কারণ, আক্রান্তের কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরা গণমাধ্যমের কার্যাবলীর অন্যতম।

এখন দেখা যাক জনাব খালিদী বিডিনিউজ বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনাগুলোর কভারেজ কিভাবে দিচ্ছে?

গত মে মাসে ২৫ তারিখ থেকে চলতি জুন মাসের ৯ তারিখ পর্যন্ত সরকারি বিভিন্ন বাহিনীর ‘ক্রসফায়ারে’ বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। বিডিনিউজের ওয়েবসাইট ঘেটে এই সময়ের ভেতরে ১১টি ঘটনায় ১২জনের নিহত (একটি ঘটনায় শুধু একজন আহত) হওয়া নিয়ে মোট ১৪টি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া গেছে। দেখার ত্রুটির কারণে এই ট্রাই ফ্রেমের মধ্যে দুয়েকটি সংবাদ হিসাব থেকে বাদ পড়ে যেতেও পারে। অবশ্য সেটা এই পর্যালোচনার জন্য মূখ্য কোনো বিষয় নয়।

সংবাদ প্রতিবেদনগুলোর লিংকসহ শিরোনাম পেছনের সর্বশেষ থেকে ক্রমানুসারে দেয়া হল। সবগুলো সংবাদ পুরোপুরি এখানে কপি করে দিলে বেঢপ দেখাবে এ কারণে শুধু শিরোনাম দেয়া। তবে অন্তত তিনটি সংবাদের পুরো ভাষ্য একদম নিচে বিডিনিউজ থেকে কপি করে দেয়া হবে। আবার কয়েকটির স্ক্রীনশটও যোগ করে দেব।

৯ জুন--
ঢাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ২

অস্ত্রসহ আটকের পর ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ১

গাইবান্ধায় পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১

৮ জুন--
যশোরে ডাকাতি মামলার আসামি ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

শিয়া মসজিদে হামলার আরেক সন্দেহভাজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

৭ জুন--
‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতদের মধ্যে অধ্যাপক রেজাউলের ‘খুনি’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে ডাকাত’ নিহত

নিচের তিনটি প্রতিবেদন ৬ জুনে আপ করা কিন্তু পরে ৭ জুনে আপডেটেড--
মসজিদে আত্মঘাতী হামলাকারী শনাক্ত, সহযোগী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত

কালশীতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে দুই ‘জঙ্গি’ নিহত

গুলিতে তিন ‘জঙ্গি’ নিহত

১ জুন আপ, ২ জুন আপডেটেড--
মাদকবিরোধী অভিযানে ‘হামলা’, গুলিতে নিহত ১

৩১ মে আপ, ১ জুন আপডেটেড--
বরিশালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ‘ডাকাত’ নিহত

৩১ মে--
সাঁথিয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে ডাকাত’ গুলিবিদ্ধ

২৫ মে আপ, ২৬ মে আপডেটেড--
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে ডাকাতির আসামি নিহত

উপরের এই ১৪টি প্রতিবেদনের মধ্যে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট পাওয়া যাবে। সেগুলো পয়েন্ট ভিত্তিক তুলে ধরা হল--

# একটি ঘটনায়ও কোনো ‘প্রত্যক্ষদর্শী’র বয়ান নেই:
কোনো এলাকায় জঙ্গি বা ডাকাতরা যখন গোপন বৈঠক বা অভিযান চালাতে যায় নিশ্চয়ই সেই এলাকা জনশূণ্য কোনো প্রান্তর হওয়ার কথা না। জঙ্গিদের টার্গেট থাকে কোনো মানুষের ওপর হামলা করা। আবার ডাকাতদের টার্গেট কোনো বাড়ি, গাড়ি বা জনবসিতে লুটপাট। সরকারি বাহিনীগুলো যখন ‘গোপন সংবাদ পেয়ে আটক একজনকেস সাথে নিয়ে’ জঙ্গি বা ডাকাতদের অপারেশনস্থলে নিজেদের অপারেশনে যায়, এবং গিয়ে ওদের বন্দুক হামলা শিকার হয়, আবার পাল্টা গুলি করে, তখন আশপাশের এলাকায় অন্তত দুয়েকজন বা ক্ষেত্র বিশেষে বহু সংখ্যক মানুষের অস্তিত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক। একেবারে একজন মানুষও কোনো ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকেন না, এমনটা খুবই অস্বাভাবিক। হতে পারে একটি ঘটনার গোলাগুলির সময় কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছিল না, যিনি সরাসরি গোলাগুলি দেখেছেন। কিন্তু বন্দুকের গুলির আওয়াজ যতদূর পর্যন্ত যায় তার মধ্যে একটি বাড়ি বা বাসার বা দোকানের একজন মানুষও গুলির শব্দ শুনে থাকবে না- তা হতে পারে না।

সংবাদ প্রতিবেদন তৈরির আগে ওইসব এলাকার কয়েকজন মানুষের সাথে কথা বললে তারা অনেকটা ধারণা দিতে পারার কথা ওই নিদিষ্ট রাতের নির্দিষ্ট সময়ে কয়টা গুলির আওয়াজ হয়েছিল, একই সাথে দুপক্ষের গোলাগুলি মনে হয়েছিল, নাকি একপক্ষের একই ধরনের গুলির কয়েকটি আওয়াজ শোনা গিয়েছিল? তাদের দেয়া তথ্যের সাথে সরকারি বাহিনীর দেয়া তথ্য যাচাই করার সুযোগ থাকে। অথবা ওই এলাকার মানুষ যদি বলেন যে, ‘আমরা কিছু শুনতে পাইনি’, তাহলে সেটিও রিপোর্টে উল্লেখ করা যায়। তাতে অন্তত বুঝা যায় যে, রিপোর্টার ঘটনার ভাষ্য নির্মাণে শুধুই সরকারি বাহিনীর উপর নির্ভর করেননি। চেষ্টা করেছেন প্রকৃত সত্যটা কী তা জানার।

কিন্তু বিডিনিউজের ১৪টি প্রতিবেদনের কোনো একটিতেও এমন কোনো ঘটনাস্থল-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্যের ছিটেফুটোও নেই। একটিতেও নেই! এটা কি সত্য জানার আগ্রহের ঘাটতি? নাকি সরকারি বাহিনীর কথাকে চুড়ান্ত সত্য বলে ধরে নেয়া- কে জানে!

# ভিকটিমের পক্ষের লোকজনের কোনো ভাষ্য নেই:

আগেই বলা হয়েছে যে, জাতিসংঘসহ মানবাধিকারের মানদণ্ড নির্ধারক আন্তর্জাতিক যাবতীয় সংগঠন এবং সংবাদমাধ্যম বিচারবহির্ভূত হত্যাকে কতটা স্পর্শকাতর বিষয় হিসেবে দেখে। এ ধরনের সংবাদের ক্ষেত্রে সবপক্ষের ভাষ্যকে পরিস্কারভাবে তুলে ধরাই নিয়ম (যেমনটা নিয়ম সজীব ওয়াজেদের বক্তব্য তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে)। বিশেষ করে ভিকটিমের কণ্ঠকে উচ্চকিত করে তুলে ধরার প্রবণতা সর্বত্র লক্ষ্যণীয়। কিন্তু বিডিনিউজের ১৪টি প্রতিবেদনের মধ্যে মাত্র একটিতে শুধু ভিকটিমের পক্ষের ভাষ্য নেয়া হয়েছে। সেই বিরল প্রতিবেদনটি হচ্ছে- “শিয়া মসজিদে হামলার আরেক সন্দেহভাজন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত”

(৮ জুন প্রকাশিত এ সংবাদটিতে ভিকটিমের (নিহতের) মায়ের যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তা প্রথমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ছিল না। বিডিনিউজের ওয়েবসাইটে আপ করার ৭ ঘন্টা পর সংবাদটি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কিছু আলোচনা শুরু হলে নিহতের মায়ের বক্তব্য যুক্ত করা হয়।)

বাকি একটি প্রতিবেদনে একটি অক্ষরও ভিকটিমের পক্ষের ভাষ্য নেই, যা যে কোনো সচেতন মানুষকে বিস্মিত না করে পারবে না!

# ভিকটিমের স্বজনের কষ্ট-আহাজারির কোনো ছবি/তথ্য নেই:

একজন ব্যক্তি যতই বড় অপরাধী হোক না কেন, তার মৃত্যুতে স্বজনের কষ্ট হবেই। আবার সেই মৃত্যু যদি আকস্মিক হয়ে থাকে তাহলে কষ্টটা আরো বেশি। প্রতিটা মৃত্যুরই একটা মানবিক দিক আছে। সাংবাদিকদের যেহেতু সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ থাকার বাধ্যবাধকতা আছে, ফলে কোনো বড় অপরাধীর স্বজন হলেও তাদের কষ্টকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। তাদের ‘ভয়েস’ তুলে ধরা সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব। আর বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ব্যক্তি যদি চিহ্নিত অপরাধী না হয়ে শুধু মাত্র ‘সন্দেহভাজন’ হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে ভিকটিম ও তার স্বজনদের মানবাধিকার রক্ষার বিষয়ে সাংবাদিকদের দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। ভিকটিমের পরিবার ও স্বজনরা তার মৃত্যুতে কিভাবে আহাজারি করছে, শোক প্রকাশ করছে তা তুলে ধরার দায়িত্ব গণমাধ্যম অস্বীকার করতে পারে না।

কিন্তু বিডিনিউজ তাদের ১৪ প্রতিবেদনের একটিতেও নিহতের স্বজনদের কষ্ট-আহাজারি সংক্রান্ত কোনো ছবি বা তথ্য না প্রকাশ করে সেটা অস্বীকারই করেছে বলা যায়।

# শতভাগ পুলিশি ভাষ্য-নির্ভর প্রতিবেদন:

যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, যখন সে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার তখন তার আগের সব অপকর্মের হিসাব বাদ পড়ে সে ভিকটিম হিসেবে গণ্য হবে (আর যদি চিহ্নিত অপরাধী না হয়ে থাকে তাহলে তো কথাই নেই)। সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে ঘটনা দুই দিকে থাকা- সরকারি বাহিনী এবং নিহত- উভয়ের ভাষ্য নিদেনপক্ষে সমান সমান গুরুত্ব পাবে (যেমনটা জনাব খালিদীর মতে গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল সজীব ওয়াজেদের বক্তব্য)। কোনোভাবেই সরকারি বাহিনীর বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করার মতো কাণ্ড সংবাদমাধ্যম করতে পারে না। বরং নিহতের পক্ষে কী জোরালো ভাষ্য আছে তা খুঁজে বের করে তুলে ধরা সাংবাদিকের দায়িত্ব।

বিডিনিউজ তাদের ১৪ প্রতিবেদনের মাত্র একটিতে পুলিশের পাশাপাশি নিহতের ভাষ্য তুলে ধরেছে। বাকি ১৩টি রিপোর্ট শতভাগ পুলিশি ভাষ্য দিয়ে তৈরি। এতে এটা খুবই নগ্নভাবে পরিস্কার হয় যে, বিডিনিউজ সাংবাদিকতার সব নীতিনৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আক্রমণকারীর ভাষ্যকে প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে মানবাধিকার লংঘনে সহযোগিতা করছে।

# ভিকটিমদের নিয়ে একটিও মানবিক স্টোরি নেই:

সাধারণত অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে মূল সংবাদের পাশাপাশি দুয়েকটি ‘মানবিক আবেদন সম্পন্ন’ প্রতিবেদন করে থাকে সংবাদমাধ্যমগুলো। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে আত্মহত্যা- যে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এমন রিপোর্ট নিয়মিতই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন ‘বাড়ি ফিরে মায়ের হাতের পিঠা খাওয়া হলো না রিমনের’ বা ‘নতুন জামা নিয়ে আর ফিরে আসবে না রিমনের বাবা’, কিংবা ‘বাবা নেই, কে চালাবে রিমনের পড়ার খরচ?’ - এ ধরনের রিপোর্ট।

এটা ঠিক যে সব অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এমন স্টোরি করার মতো উপাদান থাকে না, আবার অনেক সময় থাকলেও অপেক্ষাকৃত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ভিড়ে এ ধরনের ফিচাররইজড আইটেম পত্রিকার পাতায় স্থান দেয়া যায় না। কিন্তু ১২টি হত্যার ঘটনায় একটি মানবিক স্টোরি করার মতো উপাদান বিডিনিউজের সংবাদতাদারা পাননি- এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। আর যেহেতু এটি একটি অনলাইন পোর্টাল তাই পত্রিকার মত ‘জায়গা দেয়া যায়নি’ বলে অজুহাত তোলার কোনো সুযোগ নেই।

মানবিক আবেদন সম্পন্ন স্টোরিগুলো সাধারণত ভিকটিমের প্রতি পাঠকের সহানূভূতি এবং আক্রমণকারীর প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায়। সম্ভবত বিডিনিউজ এর কোনোটিকেই নাড়া দেয়ার ‘ঝুঁকি’ নিতে চায়নি!

# ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ শব্দটি একবারও ব্যবহার করা হয়নি:

রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক কাউকে গ্রহণযোগ্য আদালতের রায় ছাড়া হত্যা করাই বিচারবহির্ভূত হত্যা- এটা জাতিসংঘের নির্ধারিত সংজ্ঞা। সংস্থাটির Torture Victim Protection Act-এর তৃতীয় সেকশনের ‘এ’তে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে--

“a deliberate killing not authorized by a previous judgement pronounced by a regular constituted court affording all the judicial guarantees which are recognized as indispensable by civilized peoples.”
সরকারি বাহিনীগুলোর ভাষ্যমতেই, উপরের ঘটনাগুলোর বেশিরভাগ ভিকটিম নিহত হয়েছে তাকে/তাদেরকে নিয়ে অন্য সহযোগিদের ধরার জন্য অভিযান চালানোর সময়। অর্থাৎ হত্যার সময় নিহতরা (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) বাহিনীগুলোর হেফাজতে ছিল।

জাতিংসঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী বিচারবহির্ভুত হত্যা হলেও বিডিনিউজ তাদের একটি প্রতিবেদনেও শব্দটি একবারের জন্যও উল্লেখ করেনি।

# গৎবাঁধা পুলিশি গল্পকে কখনো চ্যালেঞ্জ করা হয়নি:

সাংবাদিকের দায়িত্ব হচ্ছে কায়েমি শক্তির ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করে আসল ভাষ্য কী তা তুলে ধরা। ‘সব কিছুকে সন্দেহের চোখে দেখা’ সাংবাদিক হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতাগুলোর একটি। প্রতিনিয়ত সরকারি বাহিনীগুলো ‘বন্দুকযুদ্ধে’ হত্যার যে রকম গৎবাঁধা ভাষ্য দিয়ে যাচ্ছে তা সাধারণ পাঠকদের মনেও সন্দেহের জন্ম দিতে পারলেও জনাব খালিদী সম্পাদিত বিডিনিউজের মনে দিতে পারেনি। অন্তত উপরের ১৪টি রিপোর্ট তা-ই বলে। কারণ, এখানে গৃহীত টাইমফ্রেমের মধ্যে প্রকাশিত কোনো রিপোর্টেও বাহিনীগুলোর প্রতিনিয়ত চর্বিত ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। সবগুলো ঘটনার বর্ণনা এবং ফলাফল (এক পক্ষে লোকজন নিহত হওয়া) কেন এত কাছাকাছি রকমের হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই বিবিসিকে নীতি শিক্ষা দেয়া জনাব খালিদীর।

বিবিসি বাংলাকে সঠিকভাবেই নীতিজ্ঞান দেয়া জনাব তৌফিক ইমরোজ খালিদীর নিজের সম্পাদিত বিডিনিউজের নীতিচর্চার পর্যালোচনাটি আপাতত এখানেই শেষ।

নিচে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংবাদের স্ক্রীনশট এবং টেক্সট নিচের যুক্ত করে দেয়া হল--

৯ জুনের তিনটি সংবাদের টেক্সট--

ঢাকায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ২

৬টি মন্তব্য:

  1. আসলে নিজের নীতির ব্যাপারে সচেষ্ট না হয়ে তৌফিক সাহেব অপরকে নীতির বয়ান করেছেন। এটাই নীতির চরম বরখেলাপ। কিন্তু কি আর করা!!! এমন নীতিভ্রষ্ট মানুষের দাপটে সমাজের নিতিবান মানুষেরা এখন চুপসে গেছেন।

    উত্তরমুছুন
  2. সত্য এবং সঠিক লিখেছেন. পরিশ্রম লক্ষ্যনীয়. অনেক অনেক ধন্যবাদ

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. সময়োপযোগী দরকারি কথা সব। বিশ্লেষণ, কাউন্টার। কিন্তু কাউন্টারে সময় বেশি দিয়েছেন। উনার একটা কথা খুব আপত্তিকরঃ "তাদের *উচিত ছিল না এরকম একটি বিষয় নিয়ে এ রকম স্টোরি করা"। কেননা কোন হট নিউজের ফলোআপ করাটাকে সংবাদপত্রের/সাংবাদিকের দক্ষতা হিসেবে দেখা উচিত। কিন্তু তার এই বক্তব্যে সুবিধাবাদী অবস্থান স্পষ্ট। আর যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হবার বিজ্ঞপ্তি আমরা দেখেছি। তবে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। হয়তো তাই তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে। এরকম নিউজ নতুন নয়। বিশেষ করে হাই প্রোফাইল কেসের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে একটা হাইপ তইরি করার মানসিকতা আমাদের দেশের শীর্ষ পত্রিকা/অনলাইন/টিভিতেও আছে। এরপর চলবে ফলোআপ। ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া তইরি করার খেলা। নিউজ তো দুই রকমেরঃ যা ঘটছে আর নিজেদের এজেন্ডা (জনহিতকর বা ব্যক্তি/গোষ্ঠী স্বার্থে) বাস্তবায়নে মিডিয়াগুলো যা ঘটায়।

    উত্তরমুছুন