বৃহস্পতিবার, জুন ১৬, ২০১৬

‌‘সংবাদপত্রের কালো দিবস’ যেভাবে ‘সাদা’ হয়ে যাচ্ছে

কদরুদ্দীন শিশির
২০১৫ সালের ১৬ জুন একটি ছোট্ট লেখা লিখেছিলাম ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস’টিকে (১৬ জুন) বর্তমানে সংবাদমাধ্যমগুলো কিভাবে পালন করছে- তার কিছু প্রামাণ্য চিত্র তুলে ধরে। এ বছর (২০১৬) লেখাটি আরো প্রাসঙ্গিক হয়েছে। তাই গত বছরের লেখাটিই মূলত আবার তুলে দেব। তার আগে এ বছর পত্রিকাগুলো দিনটিকে কিভাবে ‘কভার’ করেছে সে সংক্রান্ত কয়েকটি তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে দিলাম।


এ বছর ১৬ জুনের ৮টি জাতীয় পত্রিকা ঘেঁটে দেখেছি। পত্রিকাগুলো হল- প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর, ইনকিলাব, নয়াদিগন্ত ও ইত্তেফাক। এর মধ্যে কালো দিবস সংক্রান্ত সংবাদ বা মতামত পাওয়া গেছে মাত্র তিনটিতে।

এ বছর (২০১৬) যুগান্তরের ভেতরের পাতায় সংক্ষিপ্ত আকারে কালো দিবসের সংবাদ
যুগান্তর তাদের ভেতরের ১৬তম পৃষ্ঠায় ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস আজ’ শিরোনামে সাকুল্যে ৪ ইঞ্চির মতো একটি রিপোর্ট ছাপিয়েছে। ইনকিলাব “সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণের কালো দিন আজ” শিরোনামে এবং নয়াদিগন্ত “সংবাদপত্রের কালো দিবস আজ” শিরোনামে শেষের পাতায় সিঙ্গেল কলামে সংবাদ ছাপিয়েছে। এছাড়া উপসম্পাদকীয় পাতায় ইনকিলাব একটি লেখা এবং নয়াদিগন্ত “মিডিয়ার স্বাধীনতা নির্বিঘ্ন করুন” শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে।

বাকি ৫টি পত্রিকা, অর্থাৎ, প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, সমকাল, কালের কণ্ঠ ও ইত্তেফাকে- কালো দিবস বিষয়ক কোনো সংবাদ/সম্পাদকীয় বা উপসম্পাদকীয় নেই!

দুয়েকটি পত্রিকা দিবসটি উপলক্ষ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার একটি বিবৃতি ভেতরে ছোট্ট করে প্রকাশ করেছে, বাকিগুলো তাও করেনি।

২০১৫ সালের লেখাটি--

এদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসের বইয়ে একটি কালো দাগ আছে, এখন হয়তো বলতে হবে 'ছিল'! ১৬ জুন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মাত্র চারটি রেখে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়। এর প্রতিবাদে সাংবাদিকেরা দিনটিকে প্রতিবছর 'কালো দিবস' হিসেবে পালন করে আসছেন।

এই দিনে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি সব রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিক সংগঠনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনও নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। প্রতি বছর প্রায় সব পত্রিকারই ১৬ জুনের সংখ্যায় 'সংবাদপত্রের কালো দিবস আজ' শিরোনামে একটি খবর থাকতো।

কিন্তু এবারের, মানে ২০১৫ সালের, ১৬ জুন পুরোপুরি ব্যতিক্রম। আজকের দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক যায়যায়দিন এবং দৈনিক দিনকাল ছাড়া অন্য কোনো জাতীয় পত্রিকায় 'সংবাদপত্রের কালো দিবস আজ' ধরনের কোন খবর চোখে পড়েনি।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১৫ জুন সোমবার এই দিবস উপলক্ষে একটি বিবৃতি দেন। এই বিবৃতির খবরেই সীমাবদ্ধ ছিল ১৬ জুনের জাতীয় পত্রিকাগুলোর 'কালো দিবসের' পরিবেশনা।

"সংবাদপত্রের ওপর জুলুম অব্যাহত: খালেদা জিয়া"- এই শিরোনামে প্রথম আলো খালেদার বিবৃতিটি প্রকাশ করে। খবরে ভেতরে লেখা হয়েছে, "বিএনপির ভাষায়, কাল ১৬ জুন ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস’ উপলক্ষে ওই বাণী দেন খালেদা জিয়া।"।

তবে এতদিন দিবসটি 'বিএনপির ভাষায়' পালিত হয়ে আসছিল না। প্রথম আলো বিগত বছরগুলোতে এই দিনে স্বতন্ত্র খবর প্রকাশ করতো। ২০১৩ সালের ১৬ জুনের প্রথম আলোর একটি খবরের শিরোনাম ছিল "সংবাদপত্রের‘কালো দিবস’ আজ"। সেই সংবাদের ইট্রোতে লেখা হয়েছিল- "কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সাংবাদিক সংগঠন আজ রোববারকে ‘সংবাদপত্রের কালো দিবস’ হিসেবে পালন করবে।"। এখানে 'কয়েকটি' মানে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি প্রায় সব উল্লেখযোগ্য দল।
২০১৩ সালের ১৬ জুন প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণের রিপোর্ট (প্রথম আলো আর্কাইভ)

অন্যান্য জাতীয় পত্রিকাগুলোও প্রতিবছর ১৬ জুন নিয়ে আলাদা সংবাদ পরিবেশন করতো। যেমন, কালের কণ্ঠের ২০১১ সালের ১৬ জুনের এ সংক্রান্ত খবরটির শিরোনাম ছিল "আজ সংবাদপত্রের কালো দিবস পালন করবে বিএফইউজে ও ডিইউজের একাংশ"।

কিন্তু এবার নয়া দিগন্ত, যায়যায়দিন এবং দিনকাল ছাড়া আর কোনো পত্রিকা আলাদা কোনো খবর ছাপায়নি। বর্তমান সরকারের সময় নিপীড়নের শিকার দৈনিক ইনকিলাব তাদের প্রথম পাতায় খালেদা জিয়ার বিবৃতির খবরটির শিরোনামের উপরে 'সংবাদপত্রের কালো দিবস' বলে একটি 'শোল্ডার দিলেও আলাদা কোনো সংবাদ প্রকাশ করেনি দিনটি নিয়ে।

অনলাইন সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে বিডিনিউজ, বাংলানিউজ, বাংলামেইল- কোনো মূলধারার পোর্টাল খবরটি প্রকাশ করেনি।”

আবার ২০১৬-তে আসা যাক। গত ১৪ জুন মঙ্গলবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, “বর্তমান সরকারের সময়ে সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। তিনি জাতীয় সংসদে জাতীয় পার্টির সাংসদ মোহাম্মদ ইলিয়াছের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।

তথ্যমন্ত্রী বলেন, সব গণমাধ্যম বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করবে, সরকার সব সময় এমনটাই আশা করে থাকে। তবে অবাধ স্বাধীনতা ভোগের সুযোগে কোনো কোনো পত্রিকা জনহিতকর ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও প্রতিবেদন প্রকাশের পরিবর্তে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করে থাকে, যা হলুদ সাংবাদিকতার নামান্তর।” (সূত্র: প্রথম আলো)

‘হলুদ সাংবাদিকতা’র যে সংজ্ঞা তথ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের শেখালেন তার উপরের বক্তব্যে তাতে এটা স্পষ্ট যে, ‘সত্য গোপন করে অসত্য সংবাদ প্রকাশ করাটা’ হলুদ সাংবাদিকতা। কিন্তু মন্ত্রী এমনটা বলেননি যে, ‘শুধু সত্যকে সুবিধামত গোপন করাটাও হলুদ সাংবাদিকতা’। যেহেতু মন্ত্রী শেখাননি, ফলে বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও নিজ থেকে আর শিখতে যাননি এ বিষয়টি! ইতিহাসের একটি সত্যকে, যেটি যুগের পর যুগ ধরে চর্চা হয়ে আসছিল, পাশ কেটে গিয়েও তারা ভাবছেন, ‘আমরা তো হলুদ সাংবাদিকতা করিনি!’

কোন সংবাদ প্রকাশ করা যাবে? কোনটা যাবে না, কোনটা হলুদ সংবাদ, কোনটা হলুদ না- এসব বিষয়ে মন্ত্রীদের ‘শিক্ষামূলক’ বক্তব্যে গভীর বিশ্বাস ও আস্থা বাংলাদেশের ‘পূর্ণ স্বাধীন’ সংবাদমাধ্যমের!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন